মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় স্বামী হিসেবে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম]।
প্রজ্ঞাবান মহান আল্লাহ তাঁর হিকমত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে তাঁর সমস্ত রাসূলকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। যাতে সকল জাতির মানব সমাজ উত্তম আদর্শ হিসেবে তাঁদের অনুকরণ করতে পারে এবং তাঁদেরকে উত্তম আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে পারে আর তাঁদের সচ্চরিত্র ও সৎ কর্ম মোতাবেক তাদের জীবন পরিচালিত করতে পারে। আর প্রকৃত ইমানদার মুসলিম ব্যক্তির ইহালে এবং পরকালে সুখশান্তি নিহিত রয়েছে মহান আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ কুরআন এবং তদীয় বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর শিক্ষা ও আদর্শ মেনে চলার মধ্যে। তাই মুসলিম ব্যক্তির উচিত, সে যেন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর জীবনচরিত ও আদর্শের জ্ঞান লাভ করে আর তাঁর আদর্শ মোতাবেক সর্বাবস্থায় নিজের জীবন পরিচালিত করার জন্য তৎপর থাকে।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর বাড়িতে তাঁর জীবন পদ্ধতি এবং তাঁর স্ত্রীদের সাথে তাঁর জীবন পদ্ধতি ছিলো সমস্ত মানবতার জন্য সর্বোচ্চ উদাহরণ ও সর্বোত্তম আদর্শ। আর যে সমস্ত স্বামী ইহালে এবং পরকালে নিজের পরিবারের জন্য সুন্দর ও সুখময় জীবন চায়, সে সমস্ত স্বামী যেন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে সর্বোচ্চ উদাহরণ ও সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। যেহেতু মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيْرًا)، سورة الأحزاب، الآية 21. ভাবার্থের অনুবাদ: “যারা আল্লাহর করুণার আশা রাখে এবং মৃত্যুবরণ করার পরে পরকালে সুখশান্তিপূর্ণ মঙ্গলময় জীবন লাভের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদের জীবনযাত্রার পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ”। (সূরা আল আহযাব, আয়াত নং ২১)।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ চরিত্র ছিলো তাঁর স্ত্রীদের সাথে।
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] হতে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে ব্যক্তি স্বীয় পরিবারের নিকট সর্বোত্তম। আর আমি আমার পরিবারের নিকট সর্বোত্তম”। (তিরমিযী 3895)। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মুসলিম জাতির পুরুষদেরকে আদেশ প্রদান করেছেন যে, তারা যেন তাদের মহিলাগণের প্রতি সদয় হয় এবং তাদের সাথে সদাসর্বদা সচ্চরিত্র বজায় রাখে। আর যারা তাদের মহিলাগণের প্রতি সদয় হয় এবং তাদের সাথে সদাসর্বদা সচ্চরিত্র বজায় রাখে, তিনি তাদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই ক্ষেত্রে তিনি তাদের আদর্শ।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীদেরকে আনন্দ দান করতেন এবং তাঁদের বৈধ ইচ্ছা পূরণে আগ্রহী থাকতেন।
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে দেখেছি, তিনি আমাকে তাঁর চাঁদর দ্বারা ঢেকে রাখতেন যখন আমি হাবাশী খেলোয়াড়দের আমোদপ্রমোদ ও খেলাধুলার দিকে নিজে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত দেখতে থাকতাম। তারা মাসজিদে আমোদপ্রমোদ ও খেলাধুলা করতো। এখন তোমরা, অল্প বয়সের বালিকা খেলাধূলায় কতটুকু আগ্রহী হয় তা তোমরা অনুভব করতে পারো। (বুখারি 5236 এবং মুসলিম 892)। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর অনুসরণের মধ্যে এই বিষয়টিও পড়ে যে, স্বামী যেন অবশ্যই বুদ্ধিমান হয় এবং নিজের স্ত্রীর বৈধ ইচ্ছা পূরণে আগ্রহী হয় আর তার মানসিক চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখে এবং তা পূরণ করে।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] স্বামী ও স্ত্রী দুইজনের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের আনন্দদায়ক খেলাধুলাকে জায়েজ বা বৈধ হিসেবে পরিগণিত করেছেন এবং সেগুলিকে নিন্দনীয় কর্ম হিসেবে পরিগণিত করেন নি। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: “আদম সন্তানের তিনটি খেলাধুলা ছাড়া অন্যান্য খেলাধুলায় কোনো পুণ্য লাভ হয় না তবে হারাম নয়। আর সেই তিনটি বৈধ খেলাধুলা হলো এই যে, মানুষ তার ধনুক থেকে তীর ছোড়বে এবং সে তার ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দিবে আর সে তার স্ত্রীর সাথে প্রীতির সহিত আনন্দদায়ক খেলাধুলায় লিপ্ত হবে। এই সমস্ত কর্ম হলো মঙ্গলজনক বা কল্যাণদায়ক সঠিক কর্ম”। (আহমদ 17337)।
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত। তিনি একদা আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সাথে এক সফরে ছিলেন। তিনি বললেন: আমি তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তাঁর আগে চলে গেলাম। অতঃপর আমি মোটা হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাথে আবারো দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম। কিন্তু এবার তিনি আমাকে পিছনে ফেলে দিলেন এবং তিনি জয়ী হলেন। তিনি বললেন: “এই বিজয় সেই বিজয়ের বদলে হয়েছে”। (আবু দাউদ 2578)। সুতরাং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীদের সাথে প্রীতির সহিত আনন্দদায়ক খেলাধুলায় লিপ্ত হতেন এবং তাঁদেরকে আনন্দ প্রদান করতেন আর তাঁদের সাথে মঙ্গলজনক বা কল্যাণদায়ক পন্থায় রঙ্গরসিকতা করতেন। দাম্পত্য জীবন যেন একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর না হয়ে যায়।
পারিবারিক সমস্যা সমাধানে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রজ্ঞা।
কোনো বাড়িই তার সদস্যদের কিছু সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাদের এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করার সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি আমাদেরকে প্রদান করেছেন। সুতরাং আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর কতকগুলি স্ত্রীর সাথে কোনো একটি স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করছিলেন। এই অবস্থায় মুমিনদের কোনো এক মাতা বা আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কোনো একটি স্ত্রী সেই অবস্থান স্থলে খাবারের একটি থালা সেবক বা খাদেমের মাধ্যমে প্রেরণ করেছিলেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যে স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করছিলেন, তার সেই ঘরের স্ত্রী উক্ত সেবক বা খাদেমের হাতে আঘাত করেন। সুতরাং সেই খাবারের থালাটি তার হাত থেকে পড়ে যায় এবং থালাটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সেই ভেঙ্গে যাওয়া থালার টুকরোগুলি একত্রিত করলেন এবং পড়ে যাওয়া খাবার মেঝে থেকে তাতে উঠিয়ে রাখলেন। এবং বললেন: “তোমাদের মাতা ক্রোধের কারণে সাতিশয় ক্ষুব্ধা বা অত্যন্ত ক্ষুব্ধা হয়ে পড়েছে”। অতঃপর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সেই সেবককে বা খাদেমকে ততক্ষণ পর্যন্ত যেতে দিলেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার কাছ থেকে একটি ভালো থালা না এলো, যার ঘরে তিনি অবস্থান করছিলেন। সুতরাং তিনি ভালো থালাটি তাকে দিয়ে পাঠালেন, যার পাত্র ভাঙ্গা হয়েছিল। অতঃপর ভাঙ্গা থালাটি তার বাসায় তিনি রেখে দিলেন, যাঁর বাসায় তিনি অবস্থান করছিলেন। (বুখারী 5225)। পারিবারিক সমস্যা সমাধানে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রজ্ঞা।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যখন স্বাভাবিক বা স্বভাবসিদ্ধ অনুভূতির কারণে কোনো অস্বস্তিকর কর্মকাণ্ড ঘটে যেতো, তখন তিনি সেই অস্বস্তিকর কর্মকাণ্ড ঘটে যাওয়ার কারণে বিচলিত অথবা অস্থির হতেন না। এবং তিনি তাঁর কৌশল ও প্রজ্ঞার সাথে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতেন। আর যখন কোনো ঝগড়া ও বিবাদের সূত্রপাত হতো, তখন তিনি সহিষ্ণুতা অবলম্বন করতেন এবং তাঁর প্রজ্ঞার মাধ্যমে তিনি অস্থিরতা, ক্রোধ ও উত্তেজনা নিয়ন্ত্রিত করতেন এবং অস্বস্তিকর অবস্থার অবসান ঘটাতেন আর সকল পক্ষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেন।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীকে তার প্রতি রাগান্বিত হওয়া এবং তা প্রকাশ করার বিষয়টিকে মেনে নিতেন আর তা তিনি করুণা ও সদ্ভাবের সহিত মেনে নিতেন। সুতরাং আয়েশা আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আমাকে বলেছেন: “আমি জানি কখন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো এবং কখন তুমি আমার প্রতি রাগান্বিত থাকো”। আমি তাঁকে বলেছিলাম: কি করে আপনি তা বুঝতে পারছেন? তিনি বলেছিলেন: “তুমি যখন আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো, তখন তুমি বলে থাকো: মুহাম্মাদের প্রভুর শপথ! আর যখন তুমি আমার প্রতি রাগান্বিত থাকো, তখন তুমি বলে থাকো: ইবরাহীমের প্রভুর শপথ”! এই কথা শুনে আমি বলেছিলাম: আল্লাহর শপথ! আপনি ঠিকই বলেছেন, হে আল্লাহর রাসূল! এই ক্ষেত্রে শুধু আপনার নাম উচ্চারণ করা থেকেই আমি বিরত থাকি। (বুখারি 5228 ও মুসলিম 2439)।
আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর উত্তম আচরণ ও ভালো ব্যবহার তাঁর স্ত্রীদের সাথে।
আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীদেরকে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কাজকর্মে সাহায্য করতেন; তাঁদের প্রতি করুণা করতেন এবং তাঁদের জীবনযাপনের সমস্ত পদ্ধতি সহজ করে দিতেন। আর তাঁর জীবনযাপনের পদ্ধতির মধ্যে এই নিয়মটি ছিলো যে, তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিগত কাজ নিজেই করে নিতেন।
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে এই বলে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো: আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ঘরে থাকা অবস্থায় কি করতেন? তিনি বলেছেন: তিনি সাংসারিক কাজে বা গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ তিনি পরিবার-পরিজনের সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য তিনি চলে যেতেন। (বুখারি 676) আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] অন্য এক হাদীসে বলেছেন: আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নিজের জুতা নিজেই ঠিক করতেন এবং নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন এবং গৃহের কাজকর্মে তাঁর স্ত্রীদেরকে সাহায্য করতেন। যেমন:- তোমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে কেউ স্বীয় গৃহের কাজকর্ম করে থাকে। (আহমেদ 25341)।
স্ত্রীদেরকে ভালোবাসার নিদর্শন
স্ত্রীদেরকে ডাকার সময় প্রীতির শব্দ ব্যবহার করা।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে বলেছিলেন: “হে আয়েশা, ইনি হলেন জিবরিল, ইনি তোমাকে সালাম বা অভিবাদন জানিয়েছেন”। (বুখারি 3768)। আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে আদর করে “আল-হুমিরা” বলে ডাকতেন। আর “আল-হুমিরা” হলো “আল-হামরা” এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ রূপবতী, সুন্দরী এবং সাদা ও রক্তের মতো লাল রং মিশ্রিত।
স্ত্রীদেরকে খাবার খাওয়ানো।
সায়াদ বিন আবি ওয়াক্কাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাকে বলেছেন: “তুমি তোমার নিজের জন্য বা তোমার পরিবারের জন্য অথবা অন্যদের জন্য যা খরচ করবে, তার বিনিময়ে তোমাকে পুণ্য প্রদান করা হবে। এমন কি যে লোকমাটি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে, তারও বিনিময়ে তোমাকে পুণ্য প্রদান করা হবে”। (বুখারী ২৭৪২)।
স্বামী তার স্ত্রীর বিষয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করবে।
আমর ইবনুল আস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাকে যাতুস্ সালাসিল নামক যুদ্ধের সেনাপতি করে পাঠিয়ে ছিলেন। তাই তিনি বলেন: আমি তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বললাম: মানুষের মধ্যে কে আপনার নিকটে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? তিনি বললেন: “আয়িশা” (আল-বুখারী ৩৬৬২ ও মুসলিম ২৩৮৪)।
মনোযোগ সহকারে তাদের কথা শ্রবণ করা এবং তাদের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।
এই বিষয়টির প্রমাণ হলো উম্মু জারয়ের একটি লম্বা হাদীস, আর সেই হাদীসে আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এগারো জন মহিলার ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু তাঁরা সবাই এক স্থানে বসেছিলেন এবং তাদের মধ্যে থেকে প্রত্যেকেই আপন আপন স্বামীর সাথে তাদের অবস্থা বর্ণনা করতে থাকেন। আর এই লম্বা বিবরণ যতক্ষণ পর্যন্ত আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সামনে উপস্থাপন করেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর মুখ থেকে তাদের সম্পূর্ণ ঘটনা মনোযোগ সহকারে শুনেছিলেন।
আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নিজেকে তাঁর স্ত্রীদের জন্য সুশোভিত ও সুসজ্জিত করতেন।
আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে এই বলে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো: আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথমে কোন কাজটি করতেন? তিনি উত্তরে বলেন: তিনি সর্বপ্রথম দাঁতন করতেন। (মুসলিম 253) আর আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে এই বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কাছে যে সমস্ত আতর বা সুগন্ধি থাকতো, তার মধ্যে থেকে সর্বোত্তম আতর বা সুগন্ধি আমি আল্লাহর রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর গায়ে লাগাতাম। এমনকি আমি তাঁর মাথায় ও তাঁর দাড়িতে আতরের বা সুগন্ধির চিহ্ন ও ঝিকমিক করার চমক দেখতে পেতাম। (বুখারি ৫৯২৩)।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নিজের স্ত্রীদের প্রতি সততা ও আন্তরিকতার সহিত অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন।
এই সততা ও আন্তরিকতার সহিত অত্যন্ত অনুরাগী থাকার সব চেয়ে বেশি উজ্জ্বল নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে এই বিষয়টি। আর তা হলো এই যে, আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর মধ্যে খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরেও যে অবস্থাটি স্পষ্টভাবে বিরাজ করতো, সেই অবস্থাটি হলো তাঁর স্ত্রীদের সাথে তাঁর সততা ও আন্তরিকতার সহিত অত্যন্ত অনুরাগী থাকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। সুতরাং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কন্যা জ্যাইনাব [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর স্বামী আবুল আস বদরের যুদ্ধে যখন যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়েছিলেন, তখন তিনি তার স্বামীকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে কিছু সম্পদ ও তার গলার সেই হার বা নেকলেসটি প্রেরণ করেছিলেন যে, হার বা নেকলেসটি তার মাতা খাদীজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] তাকে ওই সময়ে উপহার প্রদান করেছিলেন, যে সময়ে তাঁর বিবাহ হয়েছিলো আবুল আসের সাথে। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যখন তাঁর স্ত্রী খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর সেই হার বা নেকলেসটি দেখতে পেয়েছিলেন, তখন খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর সমস্ত কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। এবং তিনি অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ও তাঁর হৃদয় অতিশয় কোমল ও করুণাপূর্ণ হয়ে যায় এবং বলেন: “যদি তোমরা রাজি থাকো তাহলে জ্যাইনাব [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর বন্দী আবুল আসকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রেরিত মুক্তিপণের সমস্ত সম্পদ ও তার গলার হার বা নেকলেসটি তাকে ফেরত দাও”। সাহাবীগণ [রাদিয়াল্লাহু আনহুম] বললেন: হ্যাঁ, ঠিক আছে! আমরা তাতেই রাজি আছি। (আবু দাউদ 2692)। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রী খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর প্রতি এতটাই সততা ও আন্তরিকতার সহিত অনুরাগী ছিলেন যে, এই বিষয়টি আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর মধ্যে গভীরভাবে ঈর্ষা সৃষ্টি করেছিলো। অথচ আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কোনো দিন খাদিজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে দেখেননি বা তার সাথে বসবাস করেননি। সুতরাং আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: খাদীজা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর প্রতি আমার যতটা ঈর্ষা হতো, ততটা ঈর্ষা আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর অন্য কোনো স্ত্রীর প্রতি হতো না। অথচ আমি তাঁকে কখনো দেখিনি। কিন্তু আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] অধিকাংশ সময়ে তাঁর কথা আলোচনা করতেন এবং কোনো কোনো সময়ে তিনি ছাগল জবাই করে সেই ছাগলের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে খাদীজার বান্ধবীদের জন্য উপহারস্বরূপ প্রেরণ করতেন। আমি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে মাঝে মধ্যে বলতাম: মনে হয় যেন দুনিয়াতে খাদীজা ছাড়া আর কোনো নারী নেই। তখন তিনি খাদীজার প্রশংসা করতেন এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথাগুলি উপস্থাপন করতেন আর তাঁর গুণের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিতেন আর বলতেন “সে এই রকম ছিলো, ওই রকম ছিলো। আর তাঁরই মাধ্যমে আমি সন্তান সন্তুতি পেয়েছি’’। (বুখারী 3818 এবং মুসলিম 2435)।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতেন তার কতকগুলি নিদর্শন:
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রীদের সম্মান করতেন এবং তাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন।
এই ক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি স্পষ্ট দৃষ্টান্ত ও নিদর্শন হলো এই যে, আলহুদায়বিয়ার দিনে যখন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মুসলিমদেরকে বলেছিলেন: “তোমরা উঠ নাহার করো অর্থাৎ কুরবানি করো এবং মাথার চুল মুণ্ডন করো বা কামিয়ে ফেলো”। কিন্তু কেউ তা পালন করেনি। এই অবস্থা দেখে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর স্ত্রী উম্মু সালামা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর কাছে প্রবেশ করেছিলেন এবং মুসলিমদের এই আচরণের কথা তাঁকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রী উম্মু সালামা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] তাঁকে বলেছিলেন: হে আল্লাহর নাবী! আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান এবং তাদের সাথে কোনো কথা না বলে আপনি আপনার উট নাহার করুন অর্থাৎ কুরবানি করুন এবং নাপিত বা ক্ষুরকারকে ডেকে আপনি আপনার মাথার চুল মুণ্ডন করুন। সেই মোতাবেক আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর কাছ থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের পশু নাহার করলেন বা কুরবানি করলেন এবং নাপিত বা ক্ষুরকারকে ডেকে নিজের মাথার চুল মুণ্ডন করলেন। এই অবস্থা দেখে মুসলিমগণ উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজ নিজ পশু নাহার করলেন বা কুরবানি করলেন আর একে অপরের মাথার চুল মুণ্ডন করলেন। (বুখারী 2731)।