মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় শিরোনাম: মৃতদেহকে গোসল দেওয়া ও কাফন পরিধান করানো
মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে, তার জন্য যা করণীয় বিষয় রয়েছে, তার বিবরণ।
মুসলিম ব্যক্তির যখন মৃত্যু প্রমাণিত হয়ে যাবে এবং আত্মা তার দেহ ত্যাগ করবে, তখন তার জন্য কতকগুলি করণীয় বিষয় রয়েছে।
যেহেতু আবু সালামা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তখন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তার কাছে প্রবেশ করেছিলেন। এবং দেখেছিলেন যে, তার চোখ তখন খোলা অবস্থায় রয়েছে ও প্রসারিত অবস্থায় রয়েছে। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তার চোখ বন্ধ করে দিয়ে ছিলেন। এবং বলেছিলেন: "إذا حضرتم موتاكم فأغمضوا البصر". (سنن ابن ماجه, رقم الحديث 1454, 1455، وصححه / حسنه الألباني). অর্থ: “তোমরা যখন তোমাদের মৃত ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হবে, তখন তার চোখ দুটি বন্ধ করে দিবে”। [সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ১৪৫৪, ১৪৫৫, আল্লামা নাসেরুদ্দিন আল আলবাণী হাদীসটিকে সহীহ / হসান বলেছেন]।
২। ধৈর্যধারণ করা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ করা
চিৎকার করে ক্রন্দন না করা আর দু:খপ্রকাশ ও শোকপ্রকাশের জন্য উচ্চস্বরে হাহাকার বিলাপ এবং আর্তনাদের উচ্চ ধ্বনি প্রকাশ না করা। মৃতব্যক্তির পরিবার পরিজনকে ও আত্মীয়-স্বজনকে ধৈর্যধারণের প্রতি উৎসাহিত করা। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর একটি মেয়েকে সেই সময় ধৈর্যধারণ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছিলেন এবং প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য এক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর কাছে পুণ্য লাভের আশা রাখতে বলেছিলেন, যখন তার একটি সন্তান মৃত্যুবরণ করেছিলো। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮৪ এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১ - (৯২২) ]।
যেমন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এক সাহাবী আবু সালামা মৃত্যুবরণ করার সময় করেছিলেন। সুতরাং তিনি বলেছিলেন: “রুহ বা অত্মা যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন চোখ তৎপ্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তিনি তারপর বললেন: "اللهم اغفر لأبي سلمة، وارفع درجته في المهديين، واخلفه في عقبه في الغابرين، واغفر لنا وله يا رب العالمين، وافسح له في قبره، ونور له فيه"(مسلم 920). অর্থ: “ হে আল্লাহ! তুমি আবু সালামাকে মাফ করে দাও, হিদায়াতপ্রাপ্তদের মধ্যে তার মর্যাদাকে উচ্চ করে দাও এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিযুক্ত কর। হে রাব্বুল আলামীন! আমাদেরকে ও তাকে মাফ করে দাও! তার জন্য কবরকে প্রশস্ত করে দাও এবং তার কবরকে আলোকময় করে দাও। (মুসলিম ৯২০)।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ، فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا، وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ، فَشَرٌّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ" (البخاري 1315، مسلم 944). অর্থ: “জানাজাকে দ্রুত নিয়ে যাবে। কেননা যদি সে সৎ লোক ও ন্যায়পরায়ণ হয়, তাহলে তোমরা তাকে তার কল্যাণের দিকে দ্রুত পৌঁছে দিবে। আর যদি সে অসৎ লোক হয়, তাহলে তোমরা একটি অকল্যাণ তোমাদের ঘাড় হতে দ্রুত নামিয়ে দিবে”। (বুখারী 1315, মুসলিম 944)।
৫। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সাহায্য করা
এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা আর তাদের কিছু বোঝা বহন করার ক্ষেত্রে সাহায্য করা। যেহেতু আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ওই সময়ে আদেশ দিয়েছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই জাফার বিন আবু তালিবের পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করার বিষয়ে, যখন জাফার বিন আবু তালিব [রাদিয়াল্লাহু আনহু] কে হত্যা করা হয়েছিল। অতএব আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "اصنعوا لآل جعفر طعاما فإنه قد أتاهم أمر شغلهم" (أبو داود 3132، الترمذي 998 وصححه، ابن ماجه 1610). অর্থ: “তোমরা জাফারের পরিবারের জন্য খাদ্য তৈরি করো। কেননা তাদের উপরে এমন বিপদ এসেছে, যে সেই বিপদ তাদেরকে ব্যস্ত করে রেখেছে”। (আবু দাউদ 3132, আল-তিরমিযী 998 এবং এটি প্রমাণিত, ইবনে মাজাহ 1610)।
মৃত ব্যক্তিকে কাফন পড়ানোর আগে এবং তাকে দাফন করানোর পূর্বে গোসল দেওয়া অপরিহার্য। আর তাকে তার পরিবার-পরিজন বা তার আত্মীয়স্বজনের কোনো মানুষ বা মুসলিম সমাজের কোনো লোক তাকে গোসল দিবে। আর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তখন তাঁকে গোসল দেওয়া হয়েছিলো অথচ তিনি ছিলেন পবিত্র ও পরিশোধিত।
মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার জন্য তার সরা শরীরে পানি প্রবাহিত করা যথেষ্ট। আর তার দেহে অপবিত্র বস্তু থাকলে, সেই অপবিত্র বস্তু দূর করা দরকার। এবং গোসল দেওয়ার সময় তার লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার প্রতি যত্ন নেওয়া জরুরি। আর নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি খেয়াল রাখা মোস্তাহাব:
১। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার সময় তার কাপড় খুলে নেওয়ার পর তার নাভি থেকে হাঁটুর পর্যন্ত লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি।
২। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার সময় তার লজ্জাস্থান ধৌত করার জন্য গোসলদাতা নিজের হাতে প্লাস্টিকের হাত মোজা বা ন্যাকড়া ব্যবহার করবে।
৩। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার সময় তার দেহের ক্ষতিকর এবং অপবিত্র বস্তু দূর করতে হবে।
৪। অতঃপর মৃত ব্যক্তির প্রসিদ্ধ নিয়ম মোতাবেক ওজুর অঙ্গগুলি ধারাবাহিকভাবে ধৌত করতে হবে।
৫। অতঃপর মৃত ব্যক্তির মাথা এবং শরীরের বাকি অংশ ধৌত করতে হবে। এবং কুলের পাতা মিশ্রিত পানি দ্বারা অথবা সাবান দ্বারা তার শরীর ধৌত করা মোস্তাহাব। তারপর তার শরীরে পানি ঢেলে দিয়ে পানি প্রবাহিত করবে।
৬। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার সময় প্রথমে তার দেহের ডান দিক ধৌত করা তারপর তার দেহের বাম দিক ধৌত করা মোস্তাহাব।
৭। মৃত ব্যক্তিকে তিনবার গোসল দেওয়া বা প্রয়োজনে তিনবারের বেশি গোসল দেওয়া মোস্তাহাব।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কন্যা জাইনাব [রাদিয়াল্লাহু আনহা] এর ইন্তেকালের সময় ওই সব মহিলাকে বলেছিলেন, যে সব মহিলা তাঁকে গোসল দিচ্ছিলেন: "اغسلنها ثلاثاً أو خمساً أو أكثر من ذلك إن رأيتن ذلك" (البخاري 1253، ومسلم 939). অর্থ: “আপনারা তাঁকে তিনবার অথবা পাঁচবার কিংবা প্রয়োজন পাঁচবারের বেশি ধৌত করবেন”। (বুখারী 1253, মুসলিম 939)।
৮। কাপড়, তুলা, ইত্যাদি রাখতে পারা যায়।
মলদ্বারে, যোনিতে বা স্ত্রীলিঙ্গে, কানে, নাকে এবং মুখে কাপড়, তুলা, ইত্যাদি রেখে দেওয়া উচিত। যাতে সেই সব স্থান থেকে অপবিত্র বস্তু বা রক্ত বের না হয়।
মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়ার সময় এবং গোসল দেওয়ার পর তার দেহে সুগন্ধি লাগানো উচিত। যেহেতু আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ওই সব মহিলাকে আদেশ প্রদান করেছিলেন, যে সব মহিলা তাঁর কন্যা জাইনাব [রাদিয়াল্লাহু আনহা] কে গোসল দিচ্ছিলেন: “তাঁরা যেন তাঁর শেষ গোসলের সময়ে কর্পূর ব্যবহার করেন”। (বুখারি 1253, মুসলিম 939)।
মৃত ব্যক্তিকে কে গোসল দিবে?
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রিয়তমা আয়েশা উম্মুলমুমেনীন [রাদিয়াল্লাহু আনহা] বলেছেন: “আমি যদি আগে বুঝতে পারতাম যা পরে বুঝতে পেরেছি, তাহলে আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে তাঁর স্ত্রীরাই গোসল দিতেন। (আবু দাউদ 3141, ইবনে মাজাহ 1464)।
মৃত ব্যক্তিকে কাফন পড়ানো তার পরিবার এবং মুসলিম সমাজের প্রতি ওয়াজিব বা অপরিহার্য অধিকার। এবং এটি হলো একটি ফরজে কিফায়া। যেহেতু আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "البسوا من ثيابكم البياض؛ فإنها من خير ثيابكم، وكفنوا فيها موتاكم" (أبو داود 3878) অর্থ: “তোমরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করবে। যেহেতু সাদা রঙের কাপড় তোমাদের সর্বোত্তম পোশাক। আর তোমরা তোমাদের মৃতদেরকে সাদা রঙের কাপড়ের কাফন দিবে”। (আবু দাউদ 3878)
কাফনের খরচ তার ওয়ারিসি সম্পত্তি বা মিরাস থেকে নেওয়া হবে। যদি তার সম্পত্তি বা ধনসম্পদ থাকে। আর যদি তার সম্পত্তি বা ধনসম্পদ না থাকে, তাহলে তার কাফনের খরচ বহন কতে হবে তাদেরকে, যারা তার জীবনযাপনের জন্য ব্যয় করতে বাধ্য, যেমন:- তার পিতা, দাদা, ছেলে এবং পোতা বা পুত্রের পুত্র। আর তা সম্ভব না হলে ধনী মুসলিম সমাজের লোকদেরকে তার কাফনের খরচ বহন করতে হবে ।
মৃত ব্যক্তি পুরুষ হোক বা মহিলা হোক, তার জরুরি কাফনের জন্য এমন পবিত্র কাপড়ের প্রয়োজন রয়েছে, যে সেই পবিত্র কাপড়ের দ্বারা তার শরীরকে ঢেকে দেওয়া যথেষ্ট হবে।