মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় স্বামী-স্ত্রী নির্বাচনের কতকগুলি মূল বিধিবিধান
প্রকৃত ইসলাম ধর্মে বিবাহ বন্ধন হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বন্ধন। তাই প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা কতকগুলি প্রাথমিক পদক্ষেপের দ্বারা এই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধনকে ঘিরে রেখেছে। এর মাধ্যমে দুই পক্ষের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধনকে মঙ্গলময় করার আয়োজন করেছে। যাতে বিবাহ বন্ধন সার্থকভাবে টিকে থাকে এবং মুসলিম ঘর স্থায়ী অবস্থায় কল্যাণময় হয়।
একটি পরিবার গঠনের জন্য দুইটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে। আর সেই দুইটি প্রধান স্তম্ভ হলো স্বামী এবং স্ত্রী। আর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা এই দুই জনের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থায়ীভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রতি বেশি আগ্রহী। এবং এই দুই জনের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থায়ীভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার বিষয়টি হলো মহান আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন ও বিশেষ অনুগ্রহ। তাই তিনি এই বিশেষ নিদর্শন ও বিশেষ অনুগ্রহের কথা সমাজকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ)، سورة الروم، الآية 21. ভাবার্থের অনুবাদ: “প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার আরেকটি নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের জীবন সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তাদের কাছে তোমাদের জীবন সুখময় ও শান্তিময় হয়। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক গভীর ভালবাসা ও কৃপা বা অনুগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। অবশ্যই যারা বুদ্ধি খাটিয়ে জীবনযাপন করে, তাদের জন্য এর মধ্যে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শন জানার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে”। (সূরা আররূম, আয়াত নং ২১)।
ভালোভাবে স্বামীস্ত্রী চয়ন করা
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও ভালোবাসায় ভরে রাখার জন্য ভালোভাবে স্বামীস্ত্রী চয়ন করা দরকার। এরই মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন সুখময় হয় এবং কল্যাণময় পরিবার গঠিত হয়।
স্বামীস্ত্রী চয়ন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান
এই বিষয়টি নারীপুরুষের মধ্যে সদাসর্বদা থাকা দরকার। তাই স্বামীস্ত্রী চয়ন করার ক্ষেত্রে নারীপুরুষ যেন গুরুত্বসহকারে খেয়াল রাখে যে তার স্ত্রী বা স্বামী যেন ন্যায়পরায়ণ পুণ্যবান ও চরিত্রবান হয়। কেননা এরই মাধ্যমে ইহকালে ও পরকালে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের পরমানন্দের মঙ্গলময় জীবন লাভ হবে।
যে নারীর মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও সচ্চরিত্রের গুণ বিরাজ করবে, সেই নারীকে বিবাহ করার প্রতি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] উৎসাহ প্রদান করেছেন। সুতরাং তিনি বলেছেন: "تنكح المرأة لأربع: لمالها، ولحَسَبها، وجمالها، ولدينها، فاظفر بذات الدين تَرِبَت يداك" (البخاري 5090، ومسلم 1466)، অর্থ: “নারীর চারটি জিনিস দেখে বিবাহ করা হয়: তার সম্পদ, উচ্চ বংশ, সৌন্দর্য ও ধর্মপরায়ণতা। সুতরাং তুমি ওই নারীকে বিবাহ করবে যে নারীর মধ্যে ধর্মপরায়ণতা ন্যায়পরায়ণতা ও সচ্চরিত্রের গুণ বিরাজ করে। তোমার হাত ধূলিধূসরিত হোক! তুমি এই দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবে। তবে যে নারীর সম্পদ আছে, উচ্চ বংশ আছে, সৌন্দর্য আছে এবং সচ্চরিত্রের গুণ ও ধর্মপরায়ণতা আছে, সে নারীকে বিবাহ করতে কোনো বাধা নেই”। (বুখারি 5090, মুসলিম 1466)
যে পুরুষ ব্যক্তির মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণ এবং এবং ধর্মপরায়ণতা বিরাজ করবে, সেই পুরুষ ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার প্রতি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] উৎসাহ প্রদান করেছেন। সুতরাং তিনি বলেছেন: «إذا أتاكم مَنْ تَرْضَوْنَ خُلُقَهُ وَدِينَهُ فزوجوه، إِلَّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ عريض» (ابن ماجه 1967) . অর্থ: “তোমাদের কাছে যখন এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসবে, যার মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণ এবং ধর্মপরায়ণতা বিরাজ করে, তার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দিবে। তা যদি না করো, তাহলে পৃথিবীতে মহা ফ্যাসাদ ও বিষম সমস্যা সৃষ্টি হবে”। (ইবনে মাজাহ 1967) অতীতের সজ্জনগণের মধ্যে থেকে কোনো কোনো ব্যক্তি বলতেন: “যখন তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে চায়বে, তখন তুমি তার বিয়ে দিবে চরিত্রবান ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির সঙ্গে। যেহেতু সে তাকে যদি ভালোবাসে, তাহলে সে তার সম্মান করবে। আর যদি সে তাকে ভালো না বাসে, তাহলে সে তার প্রতি জুলুম বা অত্যাচার করবে না”।
স্বামীস্ত্রীর মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি লাভ হওয়া
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "الأرواح جنود مجنَّدة؛ فما تعارف منها ائتلف، وما تناكر منها اختلف". (البخاري 3336، ومسلم 2638)، অর্থ: “সমস্ত আত্মা বা রূহ সংযোজিত ও সম্মিলিত বা একত্রিত আছে। অতএব সেই সমস্ত আত্মা বা রূহের মধ্যে যারা একই স্বভাবের ও একই প্রকৃতি বা একই বৈশিষ্ট্যের, তাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় ও তা অক্ষুণ্ণ ও সতেজ থাকে। আর সেই সমস্ত আত্মা বা রূহের মধ্যে যারা একই স্বভাবের ও একই প্রকৃতি বা একই বৈশিষ্ট্যের নয়, তাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় না ও তা অক্ষুণ্ণ ও সতেজ থাকে না”। (বুখারী 3336, মুসলিম 2638)। এই বিষয়টির দ্বারা স্বামীস্ত্রীর মধ্যে মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি এবং সামঞ্জস্য সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার গুরুত্ব উদ্ভাসিত ও প্রকাশিত হয়।আর এরই দ্বারা তাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয় ও তা অক্ষুণ্ণ ও সতেজ থাকে এবং তাদের বিবাহিত জীবন বা দাম্পত্য জীবন সুখময়।
তাই যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে চায়বে, সে ব্যক্তিকে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এই বলে আদেশ দিয়েছেন: "انظرْ إليها فإِنَّه أحرى أنْ يؤْدَمَ بينكُما" (الترمذي 1087) অর্থ: “তুমি তাকে নিজ চোখে দেখে নিবে; যেহেতু এরই মাধ্যমে তোমাদের দুইজনকে উত্তম পন্থায় ভালবাসার সহিত একত্রিত করা হবে”। (তিরমিযী 1087) এর উদ্দেশ্য হলো এই যে, তাদের দাম্পত্য জীবনে যেন প্রীতি, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ ও সতেজ থাকে। আর বিবাহের পূর্বে নারীকে পুরুষ নিজ চোখে দেখে নেওয়ার বিষয়টি হলো পুরুষের একটি অধিকার। এবং নারীও পুরুষকে বিবাহের পূর্বে নিজ চোখে দেখে নেওয়ার বিষয়টি হলো নারীর একটি অধিকার। এর মাধ্যমে নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারী বিবাহের পূর্বে নিজ চোখে দেখে নিতে পারবে এবং তারা তাদের পরিচয় লাভ করতে পারবে এবং তাদের বিবাহের বিষয়ে তারা তাদের অন্তরে শান্তি অনুভব করবে।
স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সমকক্ষতা বা সামঞ্জস্য থাকা
সমকক্ষতা বা সামঞ্জস্য থাকার অর্থ হলো এই যে, স্বামীস্ত্রীর মধ্যে যেন সঙ্গতি ও মিল থাকে তাদের আর্থিক অবস্থার দিক দিয়ে এবং তাদের সামাজিক অবস্থার দিক দিয়ে। কতকগুলি আলেম বা পণ্ডিতের নিকটে বিবাহ বন্ধনের বিষয়ে এটি একটি শর্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আলেম বা পণ্ডিতের নিকটে বিবাহ বন্ধনের বিষয়ে এটি একটি শর্ত বলে গণ্য করা হয় নি। তবে তাঁদের নিকটে স্বামীস্ত্রীর জন্য ন্যায়পরায়ণ, পুণ্যবান ও চরিত্রবান হওয়ার বিষয়গুলিকে কেবলমাত্র বিবাহ বন্ধনের শর্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সামাজিক অবস্থার দিক দিয়ে, জ্ঞানের দিক দিয়ে এবং আর্থিক অবস্থার দিক দিয়ে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি বা মিল না থাকলে, তাদের বিবাহিত জীবন বা দাম্পত্য জীবন সুখময় না হয়ে অস্থায়ী ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা বা ভয় রয়েছে।
বিবাহ বন্ধন যেন সন্তুষ্টচিত্তে এবং স্বেচ্ছায় সম্পাদিত হয়
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও ভালোবাসায় ভরে রাখার জন্য ভালোভাবে স্বামীস্ত্রী চয়ন করার সাথে সাথে তারা যেন বিবাহ বন্ধনের ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট থাকে এবং স্বেচ্ছায় বিবাহ বন্ধনের বিষয়টিকে তারা সাদরে গ্রহণ করে ও তাদের সম্মতিতে বিবাহ সম্পাদিত হয়। সুতরাং তাদের প্রতি যেন কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতি চাপ সৃষ্টি করা না হয় বা বল প্রয়োগ করা না হয়, যদিও সেই ব্যক্তি তাদের নিজের লোক হয় বা তাদের কাছের মানুষ হয়।
প্রকৃত ইসলাম ধর্ম নারীর প্রতি ন্যায্য বিচার করেছে এবং তার বিবাহ বন্ধনের জন্য তার সম্মতি থাকা শর্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "لاَ تُنْكَحُ الْأَيِّمُ حَتَّى تُسْتَأْمَرَ، وَلاَ تُنْكَحُ الْبِكْرُ حَتَّى تُسْتَأْذَنَ" قَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! كَيْفَ إِذْنُهَا؟ قَالَ: "أَنْ تَسْكُتَ". (صحيح البخاري، جزء من رقم الحديث6970، واللفظ له، وصحيح مسلم، وجزء من رقم الحديث 64 - (1419)، ). অর্থ: আবু হুরায়রা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: “বিধবা নারীর পরামর্শ ছাড়া যেন তার বিবাহ না দেওয়া হয়, এবং কুমারী বা অবিবাহিতা মেয়ের অনুমতি ছাড়া যেন তারও বিবাহ না দেওয়া হয়” সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল! তার অনুমতি কি ভাবে হবে? তিনি বললেন: “তার নীরব থাকাটাই তার অনুমতি বলে বিবেচিত হবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৭০ এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৪ - (১৪১৯) তবে হাদীসের শব্দগুলি সহীহ বুখারী থেকে নেওয়া হয়েছে]। খানসা বিনতে খিযাম আল আনসারিয়্যাহ [রাদিয়াল্লাহু আনহা] হতে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন যে, যখন তিনি অকুমারী ছিলেন, তখন তার সম্মতি ছাড়ায় তার পিতা তার বিয়ে দিয়েছিলেন। এই বিয়ে তিনি অপছন্দ করেছিলেন। এরপর তিনি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কাছে আসেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তার এই বিয়ে বাতিল করে দিয়েছিলেন। (বুখারি ৫১৩৮)।