মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় অসিয়ত এবং মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির বিধান
অসিয়তের অর্থ
অসিয়ত হলো: অসিয়তকৃত ব্যক্তির কাছে অসিয়তকারী তার মৃত্যুবরণ করার পর কোনো কিছু বিষয় সম্পাদন ও বাস্তবায়ন করার উপদেশ প্রদান করা, যেমন:- অসিয়তকৃত ব্যক্তিকে অসিয়তকারী তার অর্থ বা সম্পদের দ্বারা একটি মাসজিদ নির্মাণ করার উপদেশ প্রদান করবে।
মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার মৃত্যুবরণ করার পূর্বে তার অর্থ বা সম্পদের বিষয়ে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক অসিয়ত করা হলো একটি বৈধ কাজ। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: “কোনো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় যে, তার অসিয়ত করার মতো কোনো বিষয় থাকবে আর সে দুইরাত কাটাবে অথচ তার অসিয়তনামা তার নিকটে লিখিত থাকবে না”। আব্দুল্লাহ বিন ওমার [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] বলেন: আমি যখন থেকে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে এই কথা বলতে শুনেছি, তখন থেকে আমার প্রতি একটিও রাত পার হয়নি এই অবস্থায় যে, আমার কাছে আমার অসিয়তনামা প্রস্তুত নেই। (বুখারী 2738, মুসলিম 1627)।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তি ভাগ করার পূর্বে অসিয়ত বাস্তবায়ন এবং ঋণ পরিষোধ করার বিষয়টিকে প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যেহেতু মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (مِنْ بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَا أَوْ دَيْنٍ) (النساء: 11). ভাবার্থের অনুবাদ: “অবশ্য এই সব মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির বন্টন হবে মৃত ব্যক্তির অসিয়তের দাবি পূরণ ও তার ঋণ পরিশোধ করার পর”। (সূরা নিসা: 11)।
অসিয়তের কয়েকটি অবস্থা
এই অসিয়তের কয়েকটি অবস্থা রয়েছে:
১। ওয়াজিব বা অপরিহার্য অসিয়ত
যখন কোনো মুসলিম ব্যক্তির প্রতি ঋণ থাকবে বা অন্য লোকের আর্থিক অধিকার থাকবে। এবং সেই ঋণ বা লোকের আর্থিক অধিকার ক্ষেত্রে কোনো দলিল বা প্রমাণ নেই। তখন সে তার অসিয়তনামার দ্বারা ঋণ বা লোকের আর্থিক অধিকার সাব্যস্ত করবে। কেননা ঋণ পরিশোধ করা হলো ওয়াজিব বা অপরিহার্য বিষয়। আর যে বিষয়টি ব্যতীত ওয়াজেব বা অপরিহার্য কর্ম সম্পাদন করা যায় না, সে বিষয়টিও ওয়াজেব বা অপরিহার্য হয়ে যায়।
২। মোস্তাহাব বা পছন্দনীয় অসিয়ত
মোস্তাহাব বা পছন্দনীয় অসিয়ত হলো এই যে, কোনো মুসলিম ব্যক্তি তার মৃত্যুবরণ করার পর কোনো মঙ্গলদায়ক কর্ম সাধনের জন্য কিছু অর্থ বা সম্পদ দান করার উপদেশ প্রদান করবে, যেমন:- নিজের অসহায় বা অভাবী পরিবার-পরিজন বা আত্মীয় স্বজনের জন্য সদকা বা সাহায্য দান প্রদান ইত্যাদি করা। আর এই অসিয়তের জন্য কয়েকটি শর্ত নির্ধারিত রয়েছে:
ক। যে অসিয়ত যেন কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য না হয়। কেননা উত্তরাধিকারীদের জন্য মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তি মহান আল্লাহ নির্দিষ্টভাবে বন্টন করে দিয়েছেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "لا وصية لوارث" (أبو داود 3565، الترمذي 2120، ابن ماجه 2713). অর্থ: “কোনো উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো অসিয়ত নেই”। (আবু দাউদ 3565, আল -তিরমিযী 2120, ইবনে মাজাহ 2713)।
খ। অসিয়ত যেন এক তৃতীয়াংশের কম হয়। তবে এক তৃতীয়াংশের অসিয়ত করা বৈধ। কিন্তু এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা হারাম বা অবৈধ। যেহেতু একজন সাহাবী তাঁর অর্থ বা সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করতে চেয়েছিলেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁকে তাতে থেকে নিষেধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন: "الثلث والثلث كثير" (البخاري 2744، مسلم 1628). অর্থ: “অর্থের বা সম্পদের এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত করতে পারেন। তবে এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত করাও হলো অনেক বেশি”। (বুখারী ২৭৪৪, মুসলিম ১৬২৮)।
গ। অসিয়তকারী ব্যক্তি যেন ধনী হয় এবং তার অবশিষ্ট অর্থ বা সম্পদ যেন তার উত্তরাধিকারীদের জন্য যথেষ্ট হয়। যেহেতু আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সাহাবী সায়াদ বিন আবি ওয়াক্কাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] কে বলেছিলেন: "إنك أن تَذَرَ ورثتك أغنياء خير من أن تذرهم عالة يتكففون الناس" (البخاري 1295، مسلم 1628). অর্থ: “আপনার উত্তরাধিকারীদেরকে ধনী মানুষ করে রেখে যাবেন এটা ভালো এর চেয়ে যে, আপনি তাদেরকে অভাবগ্রস্ত করে রেখে যাবেন এবং তারা অন্য মানুষের কাছে হাত পাতবে আর ভিক্ষা করবে”। (বুখারি 1295, মুসলিম 1628)।
৩। মকরুহ বা অপছন্দনীয় বা অসিয়ত:
কোনো অসিয়তকারীর অর্থ বা সম্পদ যখন অল্প থাকবে এবং তার উত্তরাধিকারীরা অসহায় ও অভাবী হবে, অসিয়ত করা মকরুহ বা অপছন্দনীয় হবে। যেহেতু সে তার এই অসিয়তের দ্বারা তার উত্তরাধিকারীদেরকে সঙ্কটে এবং কঠিন বিপদে নিমজ্জিত করবে। অথচ আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সাহাবী সায়াদ বিন আবি ওয়াক্কাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] কে বলেছিলেন: "إنك أن تَذَرَ ورثتك أغنياء خير من أن تذرهم عالة يتكففون الناس" (البخاري 1295، مسلم 1628). অর্থ: “আপনার উত্তরাধিকারীদেরকে ধনী মানুষ করে রেখে যাবেন এটা ভালো এর চেয়ে যে, আপনি তাদেরকে অভাবগ্রস্ত করে রেখে যাবেন এবং তারা অন্য মানুষের কাছে হাত পাতবে আর ভিক্ষা করবে”। (বুখারি 1295, মুসলিম 1628)।
৪। হারাম বা নাজায়েজ অসিয়ত:
হারাম বা নাজায়েজ অসিয়ত হলো এই যে, সেই অসিয়তের দ্বারা প্রকৃত ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক হারাম কাজের জন্য অসিয়ত করা, যেমন:- নিজের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শুধু বড়ো ছেলেকে কিছু অর্থ বা সম্পদ দেওয়ার জন্য অসিয়ত করা অথবা নিজের স্ত্রীকে কিছু অর্থ বা সম্পদ দেওয়ার জন্য অসিয়ত করা কিংবা তার কবরের উপরে একটি গম্বুজ নির্মাণের জন্য অসিয়ত করা।
বৈধ বা জায়েজ অসিয়তের পরিমাণ
অর্থ বা সম্পদের এক তৃতীয়াংশের অসিয়ত করা বৈধ। কিন্তু এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা অবৈধ। আর উত্তম বিষয় হলো এই যে, অর্থ বা সম্পদের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম অসিয়ত করা। যেহেতু সায়াদ বিন আবি ওয়াক্কাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] যখন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে বলেছিলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আমার সমস্ত অর্থ বা সম্পদের অসিয়ত করতে পারবো? তিনি বলেছিলেন: “না”। আমি বলেছিলেন: অর্ধেক? তিনি বলেছিলেন: “না”। আমি বলেছিলেন: এক তৃতীয়াংশ? তিনি বলেছিলেন: “হ্যাঁ! এক তৃতীয়াংশ অসিয়ত করা বৈধ হবে তবে এক তৃতীয়াংশও হলো অনেক বেশি। আপনার উত্তরাধিকারীদেরকে ধনী মানুষ করে রেখে যাবেন এটা ভালো এর চেয়ে যে, আপনি তাদেরকে অভাবগ্রস্ত করে রেখে যাবেন এবং তারা অন্য মানুষের কাছে হাত পাতবে আর তাদের হাতে যা আছে তা চায়বে এবং ভিক্ষা করবে”। (বুখারি 2742)।
যার কোনো উত্তরাধিকারী নেই তার জন্য এক তৃতীয়াংশের পরিবর্তে সমস্ত অর্থ বা সম্পদের অসিয়ত করা জায়েজ আছে।
অসিয়ত বাস্তবায়িত করার বিধান
অসিয়ত বাস্তবায়িত করা হলো ওয়াজিব বা অপরিহার্য। তাই সঠিক শর্ত মোতাবেক অসিয়ত হওয়া সত্ত্বেও যদি অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়ত বাস্তবায়িত না করে, তাহলে সে গুনাগার হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: ( فَمَنْ بَدَّلَهُ بَعْدَ مَا سَمِعَهُ فَإِنَّمَا إِثْمُهُ عَلَى الَّذِينَ يُبَدِّلُونَهُ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ) البقرة/181 ভাবার্থের অনুবাদ: “অসিয়ত শুনার পর কেউ যদি তাতে কোনোরকম পরিবর্তন করে, তাহলে পাপের বোঝা তাকেই বহন করতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শুনেন, সবকিছু জানেন”। (সূরা বাকারা: 181)।
মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করবে, তখন সে তার জীবদ্দশায় যে অর্থ বা সম্পদ উপার্জন করেছে, সেই অর্থ বা সম্পদ তার মালিকানায় আর থাকবে না। তাই প্রকৃত ইসলাম ধর্ম আমাদেরকে মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তি বন্টনের বিধান প্রদান করেছে। এবং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য বা অধিকার সঠিকভাবে দেওয়ার বিধান প্রদান করেছে। তবে এই সব মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির বন্টন হবে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করার পর এবং তার অসিয়ত বাস্তবায়িত করার পর।
পবিত্র কুরআন এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর হাদীস মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির বন্টন করার স্পষ্ট পদ্ধতি আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে। যাতে মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির বন্টনের বিষয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কোনো বিবাদ সৃষ্টি না হয়। যেহেতু মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির ফয়সালা করেছেন বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান আল্লাহ। তাই কোনো ব্যক্তির জন্য মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির এই সমস্ত ফয়সালার পরিবর্তন করা বা পরিবর্ধন করা অথবা দেশের ও জনগণের প্রথার বা রীতিনীতির কারণে লঙ্ঘন করা কোনো সময় জায়েজ নয়। তাই মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির ফয়সালার বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (تِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ) (النساء: 13). ভাবার্থের অনুবাদ: “এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে থাকবে প্রবহমান ঝর্নাধারা। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। প্রকৃতপক্ষে এটাই হলো আসল সাফল্য”। (সূরা নিসা: 13)।
মৃত ব্যক্তির সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন যেন তাদের মৃত ব্যক্তির মৃত্যুবরণ করার পর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের আলেম ও পণ্ডিতগণের কাছ থেকে এবং প্রকৃত ইসলাম ধর্মের কোর্ট বা আদালতের কাছ থেকে মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তির ফয়সালার বিবরণ এবং বন্টন পদ্ধতি স্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া এবং আর্থিক বিরোধ ও ঝগড়া থেকে বিরত থাকা উচিত।