মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আল্লাহর প্রেরিত দূত বা বার্তাবহ রাসূল হওয়ার পর তাঁর জীবনচরিতের বিবরণ।
বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের বার্তাবহ রাসূল হিসেবে নিযুক্ত ও নিয়োজিত ছিলেন।
বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আল্লাহর অহী বা প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হওয়া অথবা বার্তাবহ রাসূল বা নাবী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সূত্রপাত বা সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। সুতরাং তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তা উদ্ভাসিত হতো ভোরের আভা বা আলোর মতো। এইভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহর বার্তা বা অহী অথবা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি ছিলো, তখন তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন এবং রমাজান মাসে হেরা গুহায় তিনি একাই নিঃসঙ্গ অবস্থায় অতিবাহিত করতেন। সেখানে তিনি নিরিবিলিতে মহান আল্লাহর উপাসনা করতেন। এইভাবে সেখানে তিনি তিন বছর অতিক্রম করেন। আর সেই অবস্থায় তাঁর প্রতি আল্লাহর বার্তা বা অহী অথবা প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর বয়স যখন চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়, তখন তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বার্তা বা অহী অথবা প্রত্যাদেশ লাভ করেন এবং মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের বার্তাবহ রাসূল বা নাবী হিসেবে সম্মানিত নিয়োগ করেন। সুতরাং মহান আল্লাহ তাঁকে সকল জাতির মানব সমাজের প্রতি বার্তাবহ রাসূল বা নাবী ও পয়গম্বর হিসেবে নিযুক্ত করেন। আর বিশেষভাবে তিনি তাঁকে সকল মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেন। আর মহান আল্লাহ বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে তাঁর মাঝে এবং বিশ্ববাসীর মাঝে বিশ্বস্ত আমানতদার হিসেবে সুনির্ধারিত করেন। সুতরাং তাঁর কাছে মহান আল্লাহর মহা ফেরেশতা জিবরীল এসেছিলেন মহান আল্লাহর বার্তা বা অহী অথবা প্রত্যাদেশ নিয়ে। আর মহান আল্লাহ তাঁকে সকল জাতির মানব সমাজের প্রতি বার্তাবহ রাসূল বা পয়গম্বর হিসেবে এবং তাদের জন্য করুণা হিসেবে আর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের অনুগামী ব্যক্তিদেরকে জান্নাতের সুসংবাদাতা এবং এই ধর্মের প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছেন।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ، قُمْ فَأَنْذِرْ)، سورة المدثر، الآية 1-2. ভাবার্থের অনুবাদ: “হে চাদরাবৃত বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ! তুমি ঘুম থেকে উঠো! এবং আল্লাহর অংশীদার স্থাপন করার কারণে শাস্তি হতে মানব সমাজকে সতর্ক করো। যাতে তারা আল্লাহর অংশীদার স্থাপন না করে এবং তাঁকে ছাড়া অন্যের উপাসনা না করে”। সূরা মুদাসসির (সূরা আল মুদ্দাস্সির, আয়াত নং ১-২)। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যখন প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এই আদেশ লাভ করেন, তখন তিনি মানব সমাজকে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য এক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর উপাসনার দিকে আহ্বান করেন এবং প্রকৃত ইসলাম ধর্মের সঠিক অনুগামী হয়ে সুখময় জীবন লাভ করার প্রতিও আহ্বান করেন।
মহান আল্লাহর সত্য ধর্ম প্রকৃত ইসলামের প্রতি মানব সমাজকে সংগোপনে আহ্বান।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] প্রকৃত ইসলাম ধর্মের প্রতি মানব সমাজকে প্রথমে সংগোপনে আহ্বান করার কাজ শুরু করেন। যাতে মক্কার লোকেদেরকে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে উত্তেজিত না করেন। তাই তিনি নিজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনের সামনে এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণের সামনে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের আহ্বান উপস্থাপন করতেন। তিনি আরো ওই সমস্ত লোকের সামনে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের আহ্বান উপস্থাপন করতেন, যে সমস্ত লোককে তিনি অতি সুশীল ও ন্যায়পরায়ণ এবং অত্যন্ত ভদ্র হিসেবে দেখতেন।
সর্বপ্রথমে যাঁরা প্রকৃত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের বিবরণ।
সর্বপ্রথমে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ [রাদয়িাল্লাহু আনহা]। অতঃপর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সঙ্গী আবু বাকর আস্সিদ্দিক [রাদয়িাল্লাহু আনহু] এবং তাঁর চাচাতো ভাই আলী বিন আবি তালিব [রাদয়িাল্লাহু আনহু] আর তাঁর মুক্ত করা দাস য্যাইদ বিন হারিসা [রাদয়িাল্লাহু আনহু] ।
অতঃপর প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর উপদেশ হলো প্রকাশ্যভাবে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের প্রতি আহ্বান করার জন্য। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (فاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَر)، سورة الحجر، جزء من الآية 94. ভাবার্থের অনুবাদ: “হে বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ! তুমি সকল জাতির মানব সমাজকে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম প্রকৃত ইসলামের প্রতি আহ্বান করো; যাতে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রকৃত ইসলাম ধর্ম প্রত্যাখ্যান করার বিষয়ে তাদের কোনো ওজর আপত্তি না থাকে”। (সূরা আল হিজর, আয়াত নং ৯৪ এর অংশবিশেষ)।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] যখন মহান আল্লাহর সত্য ধর্ম প্রকৃত ইসলামের প্রতি প্রকাশ্যভাবে আহ্বান করতে শুরু করেছিলেন, তখন কুরাইশ বংশের নেতারা তাঁর আহ্বানকে বিভিন্নভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং বিভিন্ন পন্থায় তার বিরুদ্ধে মানুষকে উত্তেজিত করেছিলো। সুতরাং তারা আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর আহ্বানকে নিয়ে নানা প্রকারের বিদ্রূপ, অপমান, উপহাস ও অবজ্ঞা করেছিলো এবং মুসলিমদেরকে তারা তীব্রভাবে তিরস্কার, হেনস্তা, কটাক্ষ, অবজ্ঞা ও উৎপীড়ন করেছিলো। আর তারা প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষার প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিলো, সন্দেহ পোষণ করেছিলো এবং অপপ্রচার করেছিলো এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সাথে তারা দর কষাকষি করেছিলো আর জাগতিক বিষয়ে কিছু সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে প্রকৃত ইসলামের প্রতি আহ্বান বা দাওয়াত ত্যাগ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছিলো।
মুশরিকরা বা অমুসলিমরা যখন দেখল যে, তাদের এই সমস্ত পদ্ধতির দ্বারা কোনো উপকার হলো না। এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] তাঁর দাওয়াতি কাজে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা ইসলামকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিলো। এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রতি বিভীষিকাময় অত্যাচার করতে শুরু করলো। এবং তাঁর সাহাবীগণের প্রতিও অতি ভয়ংকর অত্যাচার ও নিপীড়ন করতে আরম্ভ করলো। সুতরাং মুশরিকদের বা অমুসলিমদের উপদ্রব, উৎপীড়ন ও অত্যাচার যখন মুসলিমদের প্রতি অতি তীব্র হয়ে পড়লো। তখন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সাহাবীগণকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার আদেশ প্রদান করলেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নাবী হওয়ার পঞ্চম বছরে কতকগুলি মুসলিম নারী ও পুরুষ সাহাবী আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর দাওয়াতি কার্যক্রম এই পর্যায়ে সাফল্যের পথে ছিলো এবং সব রকমের উৎপীড়ন ও অত্যাচার সহ্য করার পথে ছিলো। এই অবস্থায় ইসরা ও মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো। আর এই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিলো আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] কে শক্তিশালী, উৎসাহিত এবং সম্মানিত করার জন্য। যেহেতু এই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিলো দাওয়াতি কার্যক্রমে অনেক ধৈর্যধারণের পর এবং একটি দীর্ঘ সময় অতিক্রম করার পর। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে মুশরিকদের বা অমুসলিমদের অনেক অত্যাচার, অবিচার ও উৎপীড় সহ্য করতে হয়েছিলো।
মক্কার বাইরে দাওয়াতি কার্যক্রমের পরিচালন ও সম্পাদন
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] প্রকৃত ইসলাম ধর্মের প্রচার মক্কা শহরের বাইরে শুরু করেন। সুতরাং তিনি এই কাজের উদ্দেশ্যে তায়েফ শহরে গমন করেন। কিন্তু তিনি যখন তায়েফবাসীর মধ্যে লক্ষ্য করেন তাঁর দাওয়াতের বিরোধিতা এবং বিমুখতা, তখন তিনি আবার মক্কা শহরে ফিরে আসেন। এবং মক্কা শহরে হজ্জের মৌসুমে বিভিন্ন গোত্রকে ও ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন।
আকাবার দুই বাইয়াত
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নাবী হওয়ার এগারোতম বছরে মক্কা শহরে হজ্জের মৌসুমে মদীনার ছয় জন লোকের সাথে মিলিত হন। মদীনার নাম তখন ছিলো ইয়াসরিব। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মদীনার সেই ছয় জন লোকের সামনে প্রকৃত ইসলামের দাওয়াত উপস্থাপন করেন এবং তার আসল তাৎপর্য তাদের সামনে তুলে ধরেন। তাঁদেরকে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন এবং পবিত্র কুরআন তাদের সামনে পাঠ করেন। সুতরাং তাঁরা প্রকৃত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁরা নিজেদের দেশে মদীনায় ফিরে আসেন এবং নিজেদের সম্প্রদায়কে প্রকৃত ইসলামের প্রতি আহ্বান করেন। তাই তাঁদের সম্প্রদায়ের মাঝে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম বিপুলভাবে প্রচারিত হয়। তারপর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নাবী হওয়ার দ্বাদশ বছরে আকাবার প্রথম বাইয়াত ও শপথ সংঘটিত হয়। এরপর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নাবী হওয়ার ত্রয়োদশ বছরে হজ্জের মৌসুমে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত ও শপথ সংঘটিত হয়। এই বাইয়াত ও শপথ সংঘটিত হয় অত্যন্ত গোপনে। আকাবার এই দ্বিতীয় বাইয়াত ও শপথ সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ওই সমস্ত সাহাবীকে মদীনায় হিজরত করার আদেশ প্রদান করেন, যে সমস্ত সাহাবী তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সুতরাং সেই সমস্ত সাহাবী দলে দলে মদীনায় হিজরত করেন।
অধিকাংশ সাহাবী মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর, আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং আবু বাকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] মদীনায় হিজরত করার জন্য যাত্রা করেন। কিন্তু তাঁরা তাদের যাত্রা করার বিষয়টিকে কুরাইশ বংশের লোকদের অমঙ্গল থেকে রক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে গোপন রাখার জন্য মদীনার বিপরীত পথ অবলম্বন করেন। এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আর আবু বাকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] হিজরতের সময় গারে সাওর বা সাওর পর্বতের একটি গুহায় আত্মগোপন করেন। সেই গুহায় তাঁরা তিন দিন অবস্থান করেন। তারপর তাঁরা মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন একটি অসাধারণ রাস্তা দিয়ে। সেই রাস্তাটি ছিলো লোহিত সাগরের উপকূলের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে মানুষ সচরাচর ও সাধারণভাবে চলাচল করতো না। সেই রাস্তা দিয়ে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং আবু বাকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] মদীনার উপকণ্ঠে আগমন করেন। তখন মুসলিমরা একটি জাঁকজমকপূর্ণ মিছিলে অত্যন্ত প্রফুল্লতার সাথে আনন্দময় ও আকর্ষণীয় পরিবেশে তাঁদেরকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানায়ন।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মদীনায় আগমন করার পর সর্বপ্রথমে যে কাজটি করেছিলেন, সেই কাজটি ছিলো আল্লাহর নাবীর মাসজিদ নির্মাণ করা এবং মুহাজিরীন ও আনসারী সাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করা। এইভাবে তিনি নতুন ইসলামী সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
মদীনায় হিজরতের পর, প্রকৃত ইসলাম ধর্মের নিয়মকানুন ও বিধিবিধান ধারাবাহিকভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হতে থাকে, যেমন:- জাকাতের বিধিবিধান, রোজার বিধিবিধান, হজ্জ পালনের বিধিবিধান, জিহাদের নিয়মকানুন, নামাজের প্রতি আহ্বান করার জন্য আজানের বিধিবিধান, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ও প্রতিরোধের বিধিবিধান এবং প্রকৃত ইসলাম ধর্মের অন্যান্য নিয়মকানুন বা বিধিবিধান।
প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি অবতীর্ণ করেন। যাতে তাঁরা তাঁদের প্রকৃত ইসলাম ধর্মের ও তাঁদের রাষ্ট্রের সংরক্ষণ করতে পারেন এবং তাঁদের প্রকৃত ইসলাম ধর্মের অবিনাশী বার্তা শান্তির সহিত প্রচার করতে পারেন। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (أُذِنَ للَّذيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا)، سورة الحج، جزء من الآية 39. ভাবার্থের অনুবাদ: “আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] ও তার সাহাবীগণ অন্যায়ভাবে আক্রান্ত ও অত্যাচারিত হয়েছে; তাই তাদেরকে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হলো”। (সূরা আল হাজ্জ, আয়াত নং ৩৯ এর অংশবিশেষ)। এই আয়াতটি হলো যুদ্ধের অনুমতি বহনকারী সর্বপ্রথম আয়াত। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] সাতাশটি বড়ো যুদ্ধ করেছেন। এবং বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে আরো ছাপ্পান্নটি অভিযান চালিয়েছেন।
হিজরতের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ
মদীনায় হিজরত করার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ সংক্ষেপে নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
হিজরতের প্রথম বছর
হিজরি সনের দ্বিতীয় বছর
হিজরি সনের দ্বিতীয় বছরে জাকাত প্রদানের বিষয়টি ফরজ বা অপরিহার্য হয়েছে, রোজা রাখার বিষয়টিও ফরজ বা অপরিহার্য হয়েছে এবং বদরের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই মহাযুদ্ধের দ্বারা মহান আল্লাহ প্রকৃত ইমানদার মুসলিম সমাজকে কুরাইশ বংশের কাফেরদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও জয়ী করেছেন।
হিজরি সনের তৃতীয় বছর
হিজরি সনের তৃতীয় বছরে ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এই যুদ্ধে প্রকৃত ইমানদার মুসলিম সমাজের পরাজয় হয়েছে। যেহেতু পর্বতের তীরন্দাজগণ বা তীর নিক্ষেপকারীগণ আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর শিক্ষার বিপরীত কাজ করে গনিমতের মাল বা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের মাল সংগ্রহ করার জন্য পর্বত হতে অবতরণ করেছিলেন।
হিজরি সনের চতুর্থ বছর
হিজরি সনের চতুর্থ বছরে বানু নাজিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বানু নাজিরের ইহুদিদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। যেহেতু তাদের মাঝে এবং মুসলিমদের মাঝে যে চুক্তি হয়েছিলো, সেই চুক্তি বানু নাজিরের ইহুদিরা ভঙ্গ করেছিলো।
হিজরি সনের পঞ্চম বছর
হিজরি সনের পঞ্চম বছরে বানী মুসতলাকের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ বা আহজাবের যুদ্ধ এবং বানী কুরাইজার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
হিজরি সনের ষষ্ঠ বছর
হিজরি সনের ষষ্ঠ বছরে প্রকৃত ইমানদার মুসলিম সমাজের মধ্যে এবং কুরাইশ বংশের লোকদের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি স্থাপিত হয়।
হিজরি সনের সপ্তম বছর
হিজরি সনের সপ্তম বছরে খায়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর এই বছরে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং মুসলিমজাতি মক্কায় প্রবেশ করেছেন এবং কজা ওমরা পালন করেছেন।
হিজরি সনের অষ্টম বছর
হিজরি সনের অষ্টম বছরে মুসলিমদের মধ্যে এবং রোমানদের মধ্যে মুতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মুসলিমজাতি মক্কা জয় করেছেন এবং হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের বিরুদ্ধে হুনাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
হিজরি সনের নবম বছর
হিজরি সনের নবম বছরে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর এই যুদ্ধটি আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সর্বশেষ যুদ্ধ ছিলো। এবং এই বছরে অনেক প্রতিনিধি দল আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর কাছে এসেছিলো। আর অনেক লোক দলে দলে প্রকৃত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। আর এই বছরটিকে বলা হয়েছে প্রতিনিধিদের বছর।
হিজরি সনের দশম বছর
হিজরি সনের দশম বছরে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বিদায়ী হজ্জ পালন করেছেন। এই বিদায়ী হজ্জে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর সাথে এক লক্ষেরও বেশি মুসলিম ব্যক্তি হজ্জ পালন করেছেন।
আর যখন প্রকৃত ইসলাম ধর্মের প্রতি আহ্বানের কাজ বা দাওয়াতি কার্যক্রম পরিপূর্ণ হয়েছিলো আর প্রকৃত ইসলাম ধর্ম সমগ্র আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষ দলে দলে প্রকৃত ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করেছিলো আর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের প্রভাব পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো এবং সকল ধর্মের উপর জয়ী হয়েছিলো, তখন আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] নিজের তিরোধান নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তাঁর প্রকৃত প্রভু সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন। এবং তাঁর কথা ও কর্মের দ্বারা এই বিষয়টি প্রকাশ হয়েছিলো যে, তাঁর এই নশ্বর বা অস্থায়ী পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
এবং হিজরতের একাদশ বছরে: রবিউল আউয়াল মাসের দ্বাদশ তারিখে সোমবার, আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মৃত্যুবরণ করেন।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মৃত্যুবরণ করেন তেষট্টি বছর বয়সে। তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাবী হওয়ার পূর্বে অতিহাহিত করেছিলেন চল্লিশ বছর বয়স। এবং তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাবী হওয়ার পর অতিহাহিত করেছিলেন তেইশ বছর বয়স। এই তেইশ বছরের মধ্যে থেকে তেরো বছর মক্কায় কেটেছে এবং দশ বছর মদীনায় কেটেছে।
আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর ধর্ম প্রকৃত ইসলাম রয়ে গেছে। আর তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু তিনি মানব জাতিকে সকল প্রকারের মঙ্গল প্রদর্শন করেছেন এবং সকল প্রকারের অমঙ্গল হতে সতর্ক করেছেন। এবং যে মঙ্গল প্রদর্শন করেছেন, সে মঙ্গল হলো একত্বের বা একত্ববাদের বিষয়টি আর যে সমস্ত বিষয়কে মহান আল্লাহ ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, সে সমস্ত বিষয়। এবং তিনি যে অমঙ্গল হতে সতর্ক করেছেন, সেই অমঙ্গল হলো শিরক বা প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর অংশীদার স্থাপন করা আর ওই সমস্ত বিষয়, যে সমস্ত বিষয়কে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহ ঘৃণা করেন ও প্রত্যাখ্যান করেন।