মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় ভাড়া দেওয়া
এটি একটি কাজের দ্বারা অথবা বৈধ ও জ্ঞাত বস্তুর দ্বারা কিংবা নির্ধারিত দায়িত্ব বা জিম্মাদারির দ্বারা সুবিধা অর্জন করা নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত বিনিময়ে।
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় ভাড়া দেওয়ার বিধান
ভাড়া দেওয়া একটি বৈধ ও জায়েজ কর্ম। এর সমর্থনে পবিত্র কুরআন এবং হাদীস ও সমস্ত আলেম বা বিদ্বানের সর্বসম্মতিক্রমে একটি গৃহীত মত রয়েছে। আর ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি হলো আসলে দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে চুক্তি সম্পাদন করা। আর এই চুক্তি যে কোনো সমাজের প্রচলিত কথা বা বাক্য দ্বারা সম্পাদিত হয়। যেমন:- আমি আপনাকে ভাড়া দিলাম এবং লিজ দিলাম ইত্যাদি।
ভাড়া দেওয়ার দলিলের মধ্যে রয়েছে
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে একজন বালিকার ভাষায় বলেছেন: (قَالَتْ إِحْدَاهُمَا يَا أَبَتِ اسْتَأْجِرْهُ إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ)، سورة القصص، الآية 26. ভাবার্থের অনুবাদ: “একজন বালিকা তার পিতাকে বলেছিলো: আব্বা! অপনি মুসাকে বিভিন্ন কাজের জন্য এবং আমাদের গবাদিপশুর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ও চরানোর জন্য নিযুক্ত করুন। কেননা সে তো সবচেয়ে ভালো শ্রমিক হবে; যেহেতু সে প্রবল শক্তিশালী ও আমানতদার বিশ্বস্ত মানুষ”। (সূরা আল কাসাস, আয়াত নং ২৬)।
অর্থ: আর নাবী কারীম [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রিয়তমা আয়েশা উম্মুলমুমেনীন [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং আবু বাকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বানু দীল গোত্রের একজন অত্যন্ত সচেতন ও অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক শ্রমিক নিয়োগ করেছিলেন। সেই লোকটি কুরাইশ বংশের কাফিরদের ধর্মাবলম্বী ছিলো। তাঁরা দুইজন [আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং আবু বাকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু]] তার উপর আস্থা রেখে নিজ নিজ যানবাহনের দুইটি উট তাকে দিয়েছিলেন এবং তিন রাত পর এইগুলি যানবাহনের উট দুইটি পাহাড়ের গুহার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। তাই সে তিন রাত পর সকালে তাদের যানবাহনের দুইটি উট নিয়ে তাঁদের কাছে উপস্থিত হয়েছিলো। (বুখারী 2264)।
ভাড়া দেওয়া বৈধ হওয়ার রহস্য
ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে মানব সমাজের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অনেক মঙ্গল নিহিত রয়েছে। সুতরাং তারা বিভিন্ন প্রকারের কাজের জন্য বিভিন্ন প্রকারের কারিগর বা শ্রমিকের মুখাপেক্ষী হয়, বসবাস করার জন্য ঘরের মুখাপেক্ষী হয়, ক্রয়বিক্রয়ের জন্য স্থান বা দোকান ঘরের মুখাপেক্ষী হয়। এর সাথে সাথে তারা পশু, গাড়ি, যন্ত্রপাতি আর মাল বহনের জন্য এবং যানবাহনের জন্য আর তারা তাদের বিভিন্ন প্রকারের প্রয়োজন পূরণ করার মুখাপেক্ষী হয়ে তাকে। কিন্তু মানব সমাজের মধ্যে অনেক মানুষ এই সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে না। তাই সমস্ত মানুষের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এবং তাদের সুবিধার ও সহযোগিতার জন্য এবং দুই পক্ষের উপকারের জন্য ভাড়া দেওয়া বৈধ করা হয়েছে। অতএব সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর এবং সমস্ত অনুগ্রহ মহান আল্লাহর।
ভাড়ার বিভাগসমূহ
শ্রমিকের প্রকারভেদ
ব্যক্তিগত বিশেষ শ্রমিক
ব্যক্তিগত বিশেষ শ্রমিক বলা হয় সেই ব্যক্তিকে, যে ব্যক্তিকে কোনো কাজের মালিক তার নিজের কাজের জন্য এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়োগ করে। সুতরাং এই ব্যক্তির জন্য তার কাজের মালিক ছাড়া অন্য কোনো লোকের কাছে কাজ করা বৈধ হবে না। অতএব সে যদি তার কাজের মালিকের সময়ে অন্য লোকের কাজ করে, তাহলে তার সেই কাজ মোতাবেক মজুরি সে কম পাবে। কিন্তু সে ওই সময়ে সম্পূর্ণ মজুরি পাবে, যে সময়ে সে নিজেকে নিজের কাজের মালিকের নিকটে অর্পন করবে এবং তার দায়িত্ব মোতাবেক পুরো কাজ সম্পন্ন করবে। আর ব্যক্তিগত বিশেষ শ্রমিক সম্পূর্ণ মজুরির অধিকারী হবে, যখন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিনা অসুখে বা বিনা অক্ষমতার কারণে অথবা বিনা ওজরে তার কাজের চুক্তি ভঙ্গ করবে কাজের মালিক। আর যদি শ্রমিকের অসুখের কারণে বা অক্ষমতার কারণে তার কাজের চুক্তি ভঙ্গ করে কাজের মালিক, তাহলে এই ক্ষেত্রে শ্রমিক যত দিন কাজ করেছে, কেবলমাত্র তত দিনের মজুরির অধিকারী হবে।
যৌথ শ্রমিক বলা হয় সেই ব্যক্তিকে, যে ব্যক্তির দ্বারা একাধিক লোক উপকৃত হয়। যেমন:- কামার, প্লাম্বার মিস্ত্রি, রঞ্জক এবং দর্জির মতো লোক, যখন সে নিজের জন্য কাজ করবে এবং যারা তার দ্বারা কাজ নিতে থাকবে। এই ধরণের যৌথ শ্রমিককে তার কাজে কোনো কাজের মালিক বাধা দেওয়ার অধিকারী হতে পারে না। এবং যৌথ শ্রমিক কাজ করা ছাড়া কোনো মজুরির অধিকারী হতে পারে না।
ভাড়া চুক্তির স্তম্ভসমূহ
ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার চুক্তির দুই পক্ষ
ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার চুক্তির দুই পক্ষ হলো: ভাড়া গ্রহীতা ও দাতা। আসলে যারা ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার পারস্পরিক স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী।
ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার পারস্পরিক স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে কথাবার্তা হলো: আসলে এটি ভাড়া দাতার পক্ষ থেকে ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করা এবং গ্রহীতার পক্ষ থেকে ভাড়া নেওয়ার সম্মতি প্রদান করা। সুতরাং যে কর্মের দ্বারা আইন মোতাবেক বা সমাজের প্রথা মোতাবেক ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার চুক্তি সাব্যস্ত হবে, সেটাই হলো ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার পারস্পরিক স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে কথাবার্তা।
উপকারিতা
উপকারিতাই হলো ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার চুক্তির আসল উদ্দেশ্য। সুতরাং উপকারিতা মানুষের হোক বা পশুর হোক কিংবা কোনো জিনিসের হোক। আসলে উপকারিতার উপরেই নির্ভর করে এই চুক্তি।
ভাড়ার মূল্য হলো: সেই জিনিসটি, যে জিনিসটি কোনো বস্তুর বা ব্যক্তির উপকারের বিনিময়ে দেওয়া হয়। আর এটি হলো আসলে বিক্রয় চুক্তির মূল্য প্রদানের সমতুল্য জিনিস।
ভাড়া সঠিক হওয়ার শর্তাবলি
ভাড়ার মূল্য প্রদান করা অপরিহার্য বা ওয়াজিব হওয়ার সময়
ভাড়ার মূল্য প্রদান করা অপরিহার্য বা ওয়াজিব হয়ে যাবে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সাথে সাথে। আর ভাড়ার মূল্য প্রদান করা অপরিহার্য বা ওয়াজিব হয়ে যাবে ভাড়ার সময় শেষ হওয়ার পর।
দুই পক্ষের সম্মতিতে ভাড়ার মূল্য প্রদান করার ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি করা চলবে অথবা বিলম্ব করাও চলবে কিংবা কিস্তি হিসেবে দেওয়া যাবে।
যদি কোনো বস্তুর ভাড়া দেওয়া হয়, তাহলে সেই বস্তুর দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার পর ভাড়ার মূল্য প্রদান করা অপরিহার্য বা ওয়াজিব হয়ে যাবে। যেহেতু আবু হুরায়রা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] হতে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] হতে বর্ণনা করেছেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেন: "قالَ اللَّهُ: ثَلاثَةٌ أنا خَصْمُهُمْ يَومَ القِيامَةِ: رَجُلٌ أعْطَى بي ثُمَّ غَدَرَ، ورَجُلٌ باعَ حُرًّا فأكَلَ ثَمَنَهُ، ورَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أجِيرًا فاسْتَوْفَى منه ولم يُعطِه أجرَه". (صحيح البخاري، رقم الحديث 2227). অর্থ: “মহান আল্লাহ বলেছেন: কিয়ামাতের দিন আমি তিন ধরণের লোকের বিরুদ্ধে বাদী হবো। প্রথমত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো, যে ব্যক্তি আমার নামে অঙ্গীকার করে এবং পরে সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। দ্বিতীয়ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো, যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে। আর তৃতীয়ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো, যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিকের দ্বারা পূর্ণ কাজ করায়, কিন্তু তাকে তার তার পূর্ণ মজুরী দেয় না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২২৭]।
যে সমস্ত অবস্থায় ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার চুক্তি নষ্ট হয়ে যায়
দুই পক্ষের মধ্যে থেকে কোনো এক পক্ষের মৃত্যুর কারণে ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার বিষয়টি বাতিল হয় না এবং ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার বস্তুটি বিক্রি করার কারণেও বাতিল হয় না। আর যে ব্যক্তি নিজের বিশেষ কাজের জন্য কোনো কিছু ভাড়া নিবে তারপর যদি সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে এই ক্ষেত্রে ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি বাতিল হয়ে যাবে। এবং কোনো বস্তুর যখন ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার নির্দিষ্ট সময় বা মিয়াদ শেষ হয়ে যাবে, তখন ভাড়া গ্রহীতা সেই বস্তু থেকে সরে যাবে আর ভাড়া দাতাকে সেই বস্তুটি হস্তান্তর করবে যদি সেই বস্তুটি অস্থাবর হয়।