মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় বর্তমান কালে নারী ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ
প্রাচীনকালে এবং অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় নারী কোনো প্রকারের মানবিক মর্যাদা ভোগ করার কোনো সুযোগ পায়নি। তাকে অবহেলিত করা হতো এবং তাকে কোনো সম্মান প্রদান করা হতো না। বরং সেই যুগে তার কোনো অধিকার ছিলো না এবং তার কোনো মর্যাদাও ছিলো না। তাকে মানবতার মূল্য না দিয়ে তাকে ক্রয়বিক্রয় করা হতো। আর তাকে পুরুষের চেয়ে অনেক নিম্ন স্তরের জীব বলে দেখা হতো।
বিভিন্ন সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকে অল্প কিছু সময় আগে পর্যন্ত নারীর অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া অব্যাহত ছিলো। এবং যদিও উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, পশ্চিমা বিশ্ব পরবর্তীতে যদিও সাম্রাজ্যের নিপীড়ন এবং চার্চের জুলুম থেকে মুক্তি লাভের আন্দোলন শুরু করেছিলো এবং পরিবর্তন নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো, কিন্তু নারীর অধিকার ও মর্যাদার সংরক্ষণের বিষয়ে এবং তার সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা ছিলো অনেক দেরিতে।
নারীর বিষয়ে পাশ্চাত্যের এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাধারা প্রধানত দুইটি দিক দিয়ে সমর্থিত ছিলো:
প্রাচীনকালের দার্শনিকরা মহিলাদেরকে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করতেন, তাদের মর্যাদা হানি করতেন এবং তাদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বা মর্যাদা ও অধিকারের কথা বিবেচনা করতেন না। আর সেই সমস্ত দার্শনিকের মধ্যে রয়েছেন: সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল।
হিন্দু ধর্মের শিক্ষা মোতাবেক কোনো নারী তার পিতামাতার রেখে যাওয়া ধনসম্পদের উত্তরাধিকারিণী হওয়ার অধিকার রাখে না। আর যদি তার স্বামী মারা যায়, তাহলে তাকে অবশ্যই তার সাথে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; যেহেতু তার স্বামীর মৃত্যুবরণ করার পরে তার বেঁচে না থাকাই তার জন্য ভালো পথ! ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের ধর্মের শিক্ষায় নারীকে অধস্তন বা নিচুস্তরের অথবা নিম্ন পর্যায়ের মানুষ হিসেবে পরিগণিত করা হয়। এবং নারীর প্রতি এইভাবে দোষারোপ করা হয় যে, সে হলো আসলে সমস্ত অমঙ্গল, অপকর্ম ও পাপের মূল। তাই তার সাথে এমন আচরণ করা হয় যে, সে যেন একটি অপবিত্র বস্তু। আর এই সমস্ত ধারণা তাদের ধর্মীয় বিকৃত বই থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় সম্মেলন থেকে উত্থিত হয়েছে। আর এই সমস্ত ধারণা তাদের পাদরি ও ধর্মযাজক বা পুরোহিত এবং গির্জার কর্তৃত্ব দ্বারা সমর্থিত হয়েছে।
বর্তমান সময়ে কতকগুলি ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ বিভিন্ন সমাজে নারীর জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
১। আধুনিকতা এবং আধুনিকতার পর
আধুনিকতা মানুষকে মহাবিশ্বের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত করে এবং তাকে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর প্রদত্ত শিক্ষা থেকে দূরীভূত করে আর তাকে এটাই শিক্ষা দেয় যে, সে নিজের বুদ্ধির দ্বারা তার নিজের জীবনের ও তার পরিবেশের এবং মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম। এর পরে যে সমস্ত ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণ বেরিয়ে এসেছে, তার বেশিরভাগই আধুনিকতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
২। যৌক্তিকতা
বুদ্ধির মান ও মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ করা হয়। এই জন্য যে, মানুষকে মহাবিশ্বের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত করা হয়।
৩। স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্ব
এর অর্থ হলো: মানুষের অধিকারের মধ্যে রয়েছে এই বিষয়টি যে, জাগতিক কর্ম ক্ষেত্রের বিষয়ে সে তার উপযোগী পন্থা মোতাবেক কৌশল অবলম্বন করবে এবং তার জীবন পরিচালিত করবে।
এটি হলো সেই মত যে মতটি মানুষের উৎপত্তি এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করে এবং তার বর্তমান আকারে উত্থিত হওয়ার ধারণা উপস্থাপন করে।
৫। নারীমুক্তির আন্দোলন
নারী মুক্তির ধারণা ইউরোপে আবির্ভূত হয়েছিল। যেহেতু যেখানে নারী সব ধরণের নিপীড়ন, নির্যাতন, জুলুম ও অবিচারের শিকার ছিলো। তাই পুরাকালের বা অতি প্রাচীনকালের উত্তরাধিকার থেকে মুক্তি লাভের ও স্বাধীনতা লাভের স্লোগান উঠেছিলো। তাই সেখানে, নারীকে কতকগুলি মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু নারী মুক্তির দাবিগুলিকে ধর্মের আওতায় এবং উচ্চ সামাজিক আদর্শ ও নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করা হয়নি। তাই সেই নারীমুক্তির আন্দোলন নিপীড়ন, নির্যাতন, জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে না হয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে এবং উচ্চ সামাজিক আদর্শ ও সচ্চরিত্রতার নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে হয়ে যায়। আর এই আন্দোলনকে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি লাভের অজুহাতে আবৃত করা হয়েছিলো।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও নারীমুক্তি
নারী মুক্তির সাথে যে সমস্ত ধ্যানধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির ও আহ্বানের যোগাযোগ রয়েছে, সে সমস্ত ধ্যানধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির ও আহ্বানের মধ্যে রয়েছে: জীবনযাপনের সমস্ত বিষয় থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করা। এবং জীবনযাপনের বিধান হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করা। আর ধর্মনিরপেক্ষতার এই অর্থটির সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে আছে নারী মুক্তির আহ্বান। অতএব নারীকে তার আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক জীবনযাপনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা ও বিধিবিধান থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করাই হলো ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাধারা এবং আহ্বান।
এর অর্থ হলো জাগতিক বিষয়ের সমস্ত ক্ষেত্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রাখা। আর মানুষের জীবনযাপনের জন্য সমস্ত ক্ষেত্রে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে মানুষের অনুশীলন থেকে সমস্ত প্রকারের নিয়মকানুন গ্রহণ করা হয়। যেমন:- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আরো অন্যান্য নিয়মকানুন।
৭। লৈঙ্গিক সমতা
প্রাথমিকভাবে লৈঙ্গিক সমতার আহ্বান শুরু হয় নারী ও পুরুষের মধ্যে শিক্ষা, কর্ম, নাগরিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে এবং নারী ও পুরুষের অধিকারে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে। এবং নারীর ক্ষেত্র থেকে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই সমস্ত অধিকার রক্ষার আহ্বান তার আসল গণ্ডি ও সীমা অতিক্রম করার পর নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য বিলীনের বিষয়ে তৎপর হয় এবং নারী ও পুরুষের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যকে দূরীভূত করে তাদেরকে শুধু একরূপে রূপান্তরিত করা হয়।
নারীমুক্তির আন্দোলনকে এবং লৈঙ্গিক সমতার আহ্বানকে নারীবাদ বা নারীবাদী চিন্তা বলা হয়৷ এই নারীবাদী চিন্তা থেকে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অন্যান্য সংস্থা বা সমিতির উৎপত্তি হয়েছে। নারীবাদী চিন্তাধারা তার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে, সমাজে অনেক ধারণা এবং অনুশীলনকে মজবুত করার চেষ্টা করেছে।
নারীবাদী চিন্তার মূলনীতি
CEDAW (সিডও) চুক্তি
কতকগুলি নারী অধিকার সংগঠন এবং নারীবাদীদের কতকগুলি সংস্থা বা সমিতি নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্য 1979 সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন চেয়েছিলো। আর সেটি হলো CEDAW (সিডও) চুক্তি।
CEDAW (সিডও) চুক্তির সারমর্ম
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) নারী ও পুরুষের সমস্ত অধিকারে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা। আর নারী ও পুরুষের মধ্যে থেকে সকল প্রকারের বৈষম্য দূরীভূত করা। অতএব নারী ও পুরুষের অধিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নানাপ্রকার ক্রীড়া ও খেলাধুলায় এবং আইন-কানুন বা বিধিবিধান ইত্যাদির ক্ষেত্রে সমান। এই নীতিটি ন্যায়সম্মত নয়। কেননা এটি তো আসমানী বিধিবিধানের পরিপন্থী বিধান, পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিপরীত নিয়ম আর সঠিক বিবেকবুদ্ধির পরিপন্থী আদর্শ এবং সৎ স্বভাব ও সচ্চরিত্রেরও পরিপন্থী নীতি। সুতরাং পবিত্র কুরআনের মধ্যে এসেছে: {وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى} [آل عمران: 36] ভাবার্থের অনুবাদ:“সমস্ত নরনারী সমস্ত ক্ষেত্রে সমান নয়”। (সূরা আল ইমরান, আয়াত নং ৩৬ এর অংশবিশেষ)। {الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ} [النساء: 34]، ভাবার্থের অনুবাদ: “আর নারীরদের উপরে পুরুষদের মর্যাদা রয়েছে তাদের প্রতি নারীরদের ভরণপোষণ ও তত্বাবধানের দায়িত্ব থাকার কারণে”। (সূরা আন্নিসা, আয়াত নং ৩৪ এর অংশবিশেষ)। {وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ} [البقرة: 228]، ভাবার্থের অনুবাদ: “আর নারীরদের উপরে পুরুষদের তত্বাবধানের মর্যাদা রয়েছে”। (সূরা আল বাকারা, আয়াত নং ২২৮ এর অংশবিশেষ)। হাদীসের মধ্যে আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "كلكم راع، وكلكم مسؤول عن رعيته... والرجل راع في أهله وهو مسؤول عن رعيته، والمرأة راعية في بيت زوجها ومسؤولة عن رعيتها". (البخاري 893، ومسلم 1829). অর্থ: “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করা হবে। ..... আর প্রত্যেক পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আর স্ত্রী তার স্বামীর ঘরে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে”। (বুখারি 893, মুসলিম 1829)। আর সবাই নিশ্চিতভাবে জানে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে থেকে সকল প্রকারের বৈষম্য দূরীভূত করার নীতিটি সঠিক বিবেকবুদ্ধিরও পরিপন্থী আদর্শ। তাই এই বিষয়য়ে খুব বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যেহেতু নারী ও পুরুষের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের কারণে কর্ম জীবনের ক্ষমতায় পার্থক্য সৃষ্টি হয়। অতএব নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে সাম্য ও প্রতিসাম্য প্রতিষ্ঠিত করা হলো আসলে তাদের স্বাভাবিক অবস্থার পরিপন্থী বিষয় এবং তাদের একটি অস্বাভাবিক আদর্শ।
CEDAW (সিডও) চুক্তি এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে শত্রুতা
CEDAW (সিডও) চুক্তি এবং নারীবাদীদের সংস্থাগুলি বা সমিতিগুলি নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং সংঘর্ষমূলক শত্রুতার সম্পর্ক আর ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের সম্পর্ক হিসাবে উপস্থাপন করে। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং সংঘর্ষমূলক শত্রুতার সম্পর্ককে তারা শেষ করতে চায়। আর এর উপায় হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে থেকে সকল প্রকারের পার্থক্য দূরীভূত করা। যেহেতু তাদের ধারণা হলো এই যে, পুরুষকে কোনো অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা ও সম্মান দেওয়ার অর্থই হলো নারীর অধিকার নষ্ট করা। এই ধরণের চিন্তাভাবনা হলো আসলে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিণাম। কেননা নারী ও পুরুষের সম্পর্ক হলো একটি পরিপূরক এবং সহযোগিতার পবিত্র সম্পর্ক। আর তাদের পবিত্র সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং সংঘর্ষমূলক শত্রুতার সম্পর্ক নয়। যেহেতু তাদের প্রত্যেকের একটি ভূমিকা রয়েছে এবং নির্ধারিত কর্ম রয়েছে নিবিড় ভালোবাসা এবং সত্য সম্প্রীতির সহিত একে অপরের পরিপূরক ও সহযাত্রী হিসেবে। যাতে তারা তাদের জীবকে খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং তাদের জীবন সমৃদ্ধশালী, আরামদায়ক, প্রীতিজনক এবং করুণাপূর্ণ হয় আর মানব জাতির সংরক্ষণের জন্য হয়। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ)، سورة الحجرات، الآية 13. ভাবার্থের অনুবাদ: “হে সকল জাতির মানব সমাজ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ আদিম মানব আদম ও এক নারী হাওয়া থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন গোত্রে তোমাদেরকে ভাগ করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই মহান আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাবান, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর বেশি অনুগত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞাতা, সর্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক”। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত নং ১৩)। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে আরো বলেছেন: (وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ)، سورة الروم، الآية 21. ভাবার্থের অনুবাদ: “প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার আরেকটি নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের জীবন সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তাদের কাছে তোমাদের জীবন সুখময় ও শান্তিময় হয়। তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক গভীর ভালবাসা ও কৃপা বা অনুগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। অবশ্যই যারা বুদ্ধি খাটিয়ে জীবনযাপন করে, তাদের জন্য এর মধ্যে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শন জানার অনেক নিদর্শন রয়েছে”। (সূরা আররূম, আয়াত নং ২১)।
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা নারী ও পুরুষের মধ্যে কী সাম্য প্রতিষ্ঠিত করার প্রতি আহ্বান জানায়?
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা নারী ও পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করে মানুষের আসল উৎপত্তি ও মর্যাদার দিক দিয়ে, দায়িত্ব পালন এবং আমানত রক্ষা করার দিক দিয়ে আর ইহকাল ও পরকালে কৃতকর্মের ফল ভোগ করার দিক দিয়ে, অধিকারের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে, ধর্মের নিদর্শন ও শিক্ষা মোতাবেক কর্ম সাধনের দিক দিয়ে এবং সচ্চরিত্রের প্রতি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিক দিয়ে। অতঃপর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা নারী ও পুরুষের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের পার্থক্যের কারণে তাদের জন্য কতকগুলি আলাদা আলাদা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত করে। সুতরাং শারীরিক গঠনের দুর্বলতার কারণে নারীর প্রতি জিহাদ করা অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক নয়। তদ্রূপ নারীর প্রতি তার মাসিক ঋতুস্রাবের সময় এবং তার নিফাস বা সন্তান প্রসবের পর রক্তস্রাবের সময় নামাজ পড়া চলবে না আর রোজা রাখাও চলবে না। অতঃপর নারী যদি ধনিনী হয় তবুও তার প্রতি ঘরের বা সংসারের খরচ বহন করা অপরিহার্য নয় বা বাধ্যতামূলক নয়। অন্যদিকে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা পুরুষের প্রতি জিহাদ করা অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক করেছে, তার স্ত্রীর ও তার ছোটো সন্তানদের খরচ বহন করাও তার উপরে অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক করেছে। আর এই সমস্ত খরচ বহন করতে সে অস্বীকার করলে অথবা অবহেলা করলে বা তাতে সে ব্যর্থ হলে তাকে তার উপযোগী শাস্তি দেওয়া হবে। আর প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষা পুরুষকে এই সমস্ত অতিরিক্ত কার্য সাধন করা ও কর্তব্য পালন করার দায়িত্ব প্রদান করেছে। এবং তাকে অতিরিক্ত কতকগুলি অধিকারও প্রদান করেছে। আর এটিই হলো আসলে ন্যায়বিচার।
মিরাস বা ওয়ারিসি সম্পত্তিতে অথবা উত্তরাধিকারে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় রয়েছে ন্যায়বিচার।
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনো অবিচার নেই; যেহেতু সে কখনও কখনও পুরুষের অংশের চেয়ে কম অংশ পেয়ে থাকে, আবার সে কখনও কখনও পুরুষের অংশের সমান অংশ পেয়ে থাকে। আর কোনো কোনো সময়ে সে আবার পুরুষের অংশের চেয়ে বেশি অংশ পেয়ে থাকে। আর অন্য সময়ে তো সে উত্তরাধিকারিণী হয়ে থাকে অথচ পুরুষ ব্যক্তি উত্তরাধিকারী হতে পারে না। এই সমস্ত বিধিবিধানের তাৎপর্য বা রহস্য প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য মহান আল্লাহই জানেন। আর এই সমস্ত বিধিবিধানের বিস্তারিত বিবরণ এই ক্ষেত্রের আলেমদের বা বিদ্যাবানদের অথবা পণ্ডিতদের বিভিন্ন গ্রন্থে বা বইয়ে পাওয়া যাবে।
প্রকৃত ইসলাম ধর্মে নারীকে সম্মানিতা করার কতকগুলি নিদর্শন
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় নারী হলো সুরক্ষিতা ও সম্মানিতা। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের মধ্যে বলেছেন: (مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَىٰ إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُوْلَٰئِكَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُوْنَ فِيْهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ)، سورة غافر، (المؤمن)، الآية 40. ভাবার্থের অনুবাদ: “যারা প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থি অবৈধ কর্মে আবদ্ধ হবে, তারা কেবল তাদের অবৈধ কর্মের অনুরূপ প্রতিফল পাবে। আর যারা প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক ঈমানের সহিত সৎকর্ম করবে, তারা পুরুষ হোক অথবা নারী হোক, অবশ্যই তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তথায় তাদেরকে অফুরন্ত জীবিকা প্রদান করা হবে”। (সূরা গাফির (আলমুমিন), আয়াত নং 40)। আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেছেন: "إِنَّ النِّسَاءَ شَقَائِقُ الرِّجَالِ" (الترمذي 113) অর্থ: “অবশ্যই নারীরা তো পুরুষের মতোই”। (তিরমিযী 113) নারীর অভিভাবক (পিতা বা স্বামী) তার বাসস্থান এবং ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে সদাসর্বদা বাধ্য থাকবে। আর নারীকে একটি দিনার বা একটি টাকাও খরচ করতে হবে না - তবে স্বেচ্ছায় সে যদি কিছু কিছু খরচ তা আলাদা কথা - সে যতই ধনিনী হোক না কেন। আর নারী পুরুষের মতোই মালের বা অর্থের অধিকারিণী হওয়ার ক্ষমতা রাখে। এবং এই বিষয়ে তার উপরে কারো আর্থিক অভিভাবকত্ব লাগবে না, সে তার পিতা হোক অথব স্বামী হোক। যেহেতু এই ক্ষেত্রে সে নিজেই মালিক; তাই এতে তার কোনো অভিভাবকের দরকার নেই। আর নারী আদানপ্রদান বা ক্রয়বিক্রয়, ভাড়া নেওয়া বা ভাড়া দেওয়া, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অথবা কোম্পানি বা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত করা বা পরিচালনা করা, বন্ধক দেওয়া বা নেওয়া, চুক্তি করা, সন্ধি বা মীমাংসা করা কিংবা মসম্যা প্রভৃতির সমাধান করা এবং অন্যান্য কার্যসম্পাদনের জন্য আইনসম্মত কর্মের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করার সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতা ও অধিকার রাখে৷