মডেল: বর্তমান বিভাগ
পাঠ্য বিষয় দান বা প্রদান করা অথবা উপহার দেওয়া
প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা সত্য উপাস্য পরাক্রমশালী সর্বশ্রেষ্ঠ মহান আল্লাহ অত্যন্ত উদার ও দয়াশীল। তাই তিনি উদারতা ও দানশীলতা অত্যন্ত ভালোবাসেন। এবং আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মানুষের মধ্যে সব চেয়ে বেশি উদার ও বদান্য ছিলেন। সুতরাং তিনি উপহার গ্রহণ করতেন এবং উপহারের পুরস্কার প্রদান করতেন। আর তিনি উপহার প্রদান করার প্রতি আহ্বান করতেন এবং উৎসাহ প্রদান করতেন। আর দানশীলতা ও বদান্যতা ছিলো তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রিয় বিষয়।
কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়াই অবিলম্বে অপর কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো জিনিসের মালিকানা প্রদান বা অর্পণ করার নাম হলো দান বা প্রদান অথবা উপহার কিংবা হেবা করা।
আমাদের কথাটি হলো: হস্তান্তর বা মালিকানা প্রদান বা অর্পণ করা। আর এই বিষয়টি হলো আসলে একটি চুক্তি বা হিবানামা। অর্থাৎ হেবা বা মালিকানা প্রদান করার দলিল বা দানপত্র ও সনদ।
কোনো জিনিস বলার অর্থ হলো: যে কোনো স্থাবর ও অস্থাবর জিনিস বা ধনসম্পদ।
হেবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: মালিকানা প্রদান করার কথা। এর দ্বারা সুবিধা ভোগ করার কথাটি খারিজ করা হয়েছে দুইটি কারণে:
হেবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: মালিকানা প্রদান করার কথা। এর দ্বারা ঋণ মুক্ত করা হয়েছে যদিও তাতে হিবা বা হেবা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু ঋণ মুক্ত শব্দ ব্যবহার করার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের বিষয়টিকে দূরীভূত করা হয়েছে।
হিবা বা হেবা বলা হয় সাধারণভাবে উপহার দেওয়া এবং দান প্রদানকে। আর এই ধরণের উপহার এবং দান প্রদান হলো আসলে পরোপকার করা, কল্যাণদায়ক কর্ম সাধন করা, রক্তের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা এবং হিতসাধন করা।
হিবা বা হেবা করার বিধান
হিবা বা হেবা করা হলো মোস্তাহাব বা পছন্দনীয় একটি কাজ। এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে আকর্ষিত করা হয়, অনেক সওয়াব ও পুণ্য লাভ করা হয়, মানুষের অন্তরে অফুরন্ত ভালোবাসা ও প্রীতি সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআন, হাদীস এবং ইজমার দ্বারা এই বিষয়টি মোস্তাহাব বা পছন্দনীয় কাজ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
হিবা বা হেবা করার প্রতি প্রকৃত ইসলাম ধর্ম মানুষকে উৎসাহিত করেছে; মানব সমাজের মধ্যে থেকে কৃপণতা, লোভ ও লালসার অমঙ্গলকে দূরীভূত করার জন্য, তাদের হৃদয়কে সৎ কাজে অকর্ষিত করার জন্য এবং তাদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন মজবুত করার জন্য। বিশেষ করে রক্তের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন শক্ত করার জন্য আর প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্য আর যার সাথে শত্রুতা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব, ঝগড়া ও বিরোধ লেগে আছে, তার উপকার করার জন্য হেবা, উপহার এবং দান প্রদান করা উচিত। যেহেতু হেবা, উপহার এবং দান প্রদান করার মাধ্যমে হৃদয় পবিত্র ও পরিষ্কার হয় এবং রক্তের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন জোরদার করা হয়। আর শত্রুতা, বিবাদ, দ্বন্দ্ব, ঝগড়া ও বিরোধের অবসান ঘটানো হয়। এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হেবা, উপহার এবং দান প্রদান করার মাধ্যমে অনেক সওয়াব ও পুণ্য লাভ হয়।
অর্থ: আল্লাহর নাবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর প্রিয়তমা আয়েশা [রাদিয়াল্লাহু আনহা] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] উপহার গ্রহণ করতেন এবং তার প্রতিদান দিতেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৫৮৫]।
অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস [রাদিয়াল্লাহু আনহুমা] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মানব সমাজের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াশীল ও দানশীল। আর রমাজান মাসে তিনি অত্যন্ত দানশীল হতেন, বিশেষ করে তিনি যখন মহা ফেরেশতা জিবরিল [আলাইহিস সালাম] এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর তিনি রমাজান মাসে প্রতি রাতেই মহা ফেরেশতা জিবরিল [আলাইহিস সালাম] এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং কুরআনের বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করতেন। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] অবশ্যই করুণার বাতাসের চেয়েও অধিক দয়াশীল ও দানশীল ছিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬ এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫০ -( ২৩০৮), তবে হাদীসের শব্দগুলি সহীহ বুখারী থেকে নেওয়া হয়েছে]।
দান বা প্রদান করা অথবা উপহার দেওয়া কিংবা হিবা বা হেবার স্তম্ভ
প্রকৃত ইসলাম ধর্মের আলেমগণ বা বিদ্বানগণ এই বিষয়ে একমত যে, দান বা প্রদান করা অথবা উপহার দেওয়া কিংবা হেবা করার প্রস্তাবটিই হলো তার প্রকৃত স্তম্ভ। এর পর তাদের মধ্যে আবার বিভিন্ন মত প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং দান বা প্রদান করা অথবা উপহার দেওয়া কিংবা হেবা করার বিষয়টি কেবলমাত্র দানকারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু হেবাকৃত বস্তু যে ব্যক্তিকে তিনি দান করবেন, সে ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত হেবাকৃত বস্তুকে গ্রহণ না করবে এবং নিজ আয়ত্তে না নিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত, সে তার মালিক হতে পারবে না। অতএব হেবাকৃত বস্তুকে গ্রহণ করা এবং নিজ আয়ত্তে নেওয়ার বিষয়টি হলো হেবার শুধুমাত্র পরিণাম, হেবার চুক্তি নয়।
দান বা প্রদান করা অথবা উপহার দেওয়া কিংবা হিবা বা হেবা করার শর্তাবলি:
হেবাকৃত বা দানকৃত বস্তু যেন অজানা ও অস্তিত্বহীন না হয়। এই শর্তের বিষয়ে প্রকৃত ইসলাম ধর্মের আলেমগণ বা বিদ্বানগণ নিজেদের মধ্যে মতভেদ প্রকাশ করেছেন। এবং এর সাথে সাথে এই শর্তের বিষয়েও তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ প্রকাশ করেছেন যে, হেবাকৃত বা দানকৃত বস্তু যেন সুনির্দিষ্টভাবে বা পাকাপাকিভাবে ভাগ করা থাকে এবং তাতে অন্য কোনো মানুষের কোনো অংশ না থাকে।
যে ব্যক্তি কোনো কর্মকর্তাকে কিংবা কর্মচারীকে অথবা অন্য কোনো লোককে এমন কোনো সুবিধা লাভ করার জন্য কিংবা মুনাফা অর্জন করার জন্য কোনো বস্তু হেবা করবে বা দান করবে অথবা উপহার দিবে, যে সুবিধা লাভ করার কিংবা মুনাফা অর্জন করার সে কোনো অধিকার রাখে না, তাহলে এই ক্ষেত্রে তার জন্য সেই হেবা করা বা দান করা অথবা উপহার দেওয়া হারাম হয়ে যাবে। তদ্রূপ হেবা গ্রহণকারীর জন্য বা দান গ্রহণকারীর জন্য সেই হেবাকৃত বা দানকৃত বস্তু তার কাছ থেকে নেওয়া হারাম হয়ে যাবে। যেহেতু এই ধরণের হেবা করা বা দান করা অথবা উপহার দেওয়া হবে আসলে ঘুষ আদানপ্রদানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। আর ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহণকারীর প্রতি অভিশাপ দেওয়া হয়েছে।
যে ব্যক্তি কোনো কর্মকর্তার কিংবা কর্মচারীর অথবা অন্য কোনো লোকের জুলুম অন্যায় অত্যাচার অবিচার উপদ্রব বা দুর্ব্যবহার থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে অথবা নিজের সত্য ও ন্যায্য অধিকার গ্রহণের জন্য অথবা নিজের সত্য ও ন্যায্য অধিকারের সংরক্ষণের জন্য কিছু হেবা করে বা দান করে অথবা উপহার দেয়, তাহলে এই ক্ষেত্রে হেবাকারীর বা দানকারীর কিংবা উপহার প্রদানকারীর জন্য তা বৈধ হবে এবং এই হেবা বা দান অথবা উপহার গ্রহণকারীর জন্য তা হারাম হবে।
আবু হুমায়দ সায়েদী [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] আসাদ গোত্রের ইবনুল উতাইবিয়া নামের একটি লোককে সদাকার বা জাকাতের মাল সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি সেই কাজ থেকে ফিরে এসে বললেন: এই সমস্ত অর্থ ও মাল আপনাদের এবং এইগুলি আমার জন্য আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। তাই আল্লাহর বার্তাবহ রাসূল বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] মিম্বারের উপরে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি করলেন এবং বললেন: “কর্মকর্তা বা অধিকর্তা কী হলো? কোনো কর্মকর্তা বা অধিকর্তা অথবা পরিচালক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য এটা বিধেয় বা উচিত নয় যে, আমি তাকে একটি কর্মে নিয়োগ করে প্রেরণ করবো আর সে ফিরে এসে বলবে: এই সমস্ত অর্থ ও মাল আপনাদের জন্য এবং এইগুলি আমার জন্য আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। অতএব যদি সে তার পিতামাতার গৃহে বসে থাকতো ও দেখা যেতো যে, তাকে উপহার দেওয়া হচ্ছে কিনা? যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, সেই সত্তার কসম! সদাকার বা জাকাতের মাল হতে স্বল্প পরিমাণও যে ব্যক্তি আত্মসাৎ করবে, সে ব্যক্তি তার কাঁধে করে সেই মালসহ কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। যদি সেই মাল উট হয়, তাহলে সে উটের আওয়াজ করতে থাকবে। অথবা সেই মাল যদি গাভী হয়, তাহলে সে গাভীর মত করে আওয়াজ করবে। কিংবা সেই মাল যদি ছাগল হয়, তাহলে সে ছাগলের মত আওয়াজ দিবে”। অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাত এমনভাবে উপরে উঠালেন যে, আমরা তাঁর বগলের শুভ্রতার সাথে কালোর সংমিশ্রণ দেখতে পেলাম। অতঃপর তিনি বললেন: আমি কী আল্লাহর বিধান তোমাদের কাছে পৌঁছে দিলাম? এই কথাটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১৭৪ এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস নং 26 -(১৮৩২), তবে হাদীসের শব্দগুলি সহীহ বুখারী থেকে নেওয়া হয়েছে]। الخُوار: গাভীর বা গরুর আওয়াজ الرُّغاء: উটের আওয়াজ العُفرة: শুভ্রতার সাথে কালোর সংমিশ্রণ تَيْعَر: চিৎকার করবে জোরে আওয়াজ করবে